ওরা মানুষ নয়, পতিতা!
মাহমুদুর রহমান
তখন রাত ৮টা কিংবা সোয়া ৮টা বাজে। বিজয়নগরে একটি কাজ সেরে হলে ফেরার উদ্দেশে কাকরাইল মোড়ে আসার জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সামনে দিয়ে হাঁটছিলাম। পেভমেন্টে খুব বেশি আলো নেই। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের গেটের দু-একটি বাতি, বিশেষ করে গাড়ির আলোয় যতটুকু আলোকিত ছিল এই যা। এ পাশটায় কোনো দোকান কিংবা লাইটপোস্ট নেই বলে ঝলমলে আলো নেই এ ফুটপাতে। কিন্তু তার পরও মোটামুটি সবকিছুই ভালোভাবে দেখা যায়। সঙ্গে আমার এক বন্ধু। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো
২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী ১০-১৫ জন নারী। অতিমাত্রায় মেকআপ নেয়া এসব মেয়ে দু-চার হাত দূরে দূরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বছরখানেক আগে পত্রিকার কাজ করতে গিয়ে এ জায়গাটা সম্পর্কে জেনেছিলাম। তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না।
এরাই সেই নারী যারা জীবনযুদ্ধে হেরে গেছে। সমাজ এদের জায়গা দেয়নি। এরা যৌনকর্র্মী। যাদের কটূক্তি করে, ঘৃণাভরে বলা হয় পতিতা। কথা বলার চেষ্টা করি ওদের একজনের সঙ্গে। কিন্তু ওরা পত্রিকায় কাজ করি জেনে কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছে না। যেভাবেই হোক আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের এক গেটম্যানের সহায়তায় মিনিট পাঁচেকের একটি মিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। মেয়েটার বয়স ২০-২৫ হবে। নাম জিজ্ঞেস করলেও কোনোমতেই সে তার নাম বলতে রাজি হয়নি। তবে সে জানালো কোনো সখ বা ইচ্ছের বশবর্তী হয়ে সে এ পেশায় নামেনি। বাড়ি নাটোরে। ধর্ষিত হয়েছিল একই গ্রামের যুবকদের হাতে। ধর্ষিত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি কিভাবে হয়েছিল তা সে জানে না। তবে এটুকু জানে, হাসপাতালে তার খবর নিতে বাড়ির গরিব বাবা-মা কেউই আসেননি।
যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল সে। কোনোদিন বাড়ি ফিরে যায়নি। ঢাকায় এসে ২০০৪-এর শেষের দিকে দেহপসারিণী হিসেবে জীবন সংগ্রাম শুরু করেছিল। এখনো চলছে। সর্বোচ্চ ১০ জনের দ্বারাও ধর্ষিত হয়েছিল একবার। প্রায়ই কোনো পারিশ্রমিক পায় না ওরা। সাধারণত ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত পায় প্রতি রাতে। আবার মাঝে মাঝে কন্ট্রাক্ট করে গিয়েও সারারাত ধর্ষিত হয়ে সকালে ফিরতে হয় শূন্য হাতে। আমাদের করা বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলে সে। আমি সবচেয়ে আশ্চর্য ও ব্যথিত হয়েছি, যখন আমি এই লেখাটি লেখা শুরু করেছি। আমার এক বন্ধু লেখার বিষয়টি দেখে আমাকে খুব উৎকণ্ঠা ভরে বললো, ‘তুই শেষ পর্যন্ত এসব নোংরা বিষয় নিয়ে লিখতেছিস’? আমার বন্ধুর কথা বলার ভাবটা এরকম ছিল, যেন এই যৌনকর্মীদের নিয়ে আলোচনা করাই মহাপাপ। ওরা যেন সমাজের উচ্ছিষ্ট, ওরা মানুষ নয়, ওরা পতিতা। আমার বন্ধুকে আমি দোষ দেই না। কারণ এ ধরনের মানসিকতা আমাদের সমাজই ওকে তৈরি করে দিয়েছিল। এটাতো অত্যন্ত ছোট ব্যাপার।
যখন দেখি কোনো নারী ধর্ষিত হয়ে সমাজে চরমভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে সবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, তখন আমাদের এই সমাজের প্রতি ঘৃণা হয়। আমি বুঝি না একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে এ মেয়েটার দোষ কি? ভেবে দেখুন, পরিবার বা সমাজের দায়িত্ব ছিল এ মেয়েটিকে রক্ষা করা। নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু সমাজ কতটুকু নিরাপত্তা দিতে পেরেছে একটা নারীর। আমি একটু কম বুঝি, তাই আমার বুঝতে কষ্ট হয়, যে নারী ১৯৭১ সালে দেশের জন্য জীবন ও ইজ্জত দিয়েছে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক তাকে বীরাঙ্গনা খেতাব দেয়ার পরও যখন তার পরিবার ও সমাজ তাকে চরমভাবে বর্জন করেছিল তখন সে নারীর টানবাজারের পতিতাপল্লীতে যাওয়া ছাড়া আর কিই বা করার ছিল। আমরা কেন বুঝতে চাই না সখ করে কোনো নারী তার জীবনে এ পেশা বেছে নেয় না। মনে রাখতে হবে, যারা এ পেশায় নিজেদের নিযুক্ত করেছে তাদের আর কোনো উপায় ছিল না জীবনকে টেনে নেয়ার।
হয়তো বা এ নারীদের কেউ কেউ সারারাত তার সব শরীর বিকিয়ে দিয়ে সকালবেলা যা পাচ্ছে তা দিয়ে অসুস্থ মা অথবা বাবার জন্য ওষুধ কিনে বাসায় ফিরছে। আবার কেউ কেউ তার ছোট ভাই-বোনের পরীক্ষার ফি জোগাড় করার জন্য খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা শুধু দেখি ওরা কি করে। কিন্তু কেন করে সেটা কি কখনো জিজ্ঞাসা করে দেখেছি? আমাদের ভাবা উচিত ওরা আমাদের মতোই। ওরা সমাজের বিচ্ছিন্ন কোনো অংশ নয়। নিঃসন্দেহে ওদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা উচিত।
তখন রাত ৮টা কিংবা সোয়া ৮টা বাজে। বিজয়নগরে একটি কাজ সেরে হলে ফেরার উদ্দেশে কাকরাইল মোড়ে আসার জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সামনে দিয়ে হাঁটছিলাম। পেভমেন্টে খুব বেশি আলো নেই। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের গেটের দু-একটি বাতি, বিশেষ করে গাড়ির আলোয় যতটুকু আলোকিত ছিল এই যা। এ পাশটায় কোনো দোকান কিংবা লাইটপোস্ট নেই বলে ঝলমলে আলো নেই এ ফুটপাতে। কিন্তু তার পরও মোটামুটি সবকিছুই ভালোভাবে দেখা যায়। সঙ্গে আমার এক বন্ধু। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো
২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী ১০-১৫ জন নারী। অতিমাত্রায় মেকআপ নেয়া এসব মেয়ে দু-চার হাত দূরে দূরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বছরখানেক আগে পত্রিকার কাজ করতে গিয়ে এ জায়গাটা সম্পর্কে জেনেছিলাম। তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না।
এরাই সেই নারী যারা জীবনযুদ্ধে হেরে গেছে। সমাজ এদের জায়গা দেয়নি। এরা যৌনকর্র্মী। যাদের কটূক্তি করে, ঘৃণাভরে বলা হয় পতিতা। কথা বলার চেষ্টা করি ওদের একজনের সঙ্গে। কিন্তু ওরা পত্রিকায় কাজ করি জেনে কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছে না। যেভাবেই হোক আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের এক গেটম্যানের সহায়তায় মিনিট পাঁচেকের একটি মিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। মেয়েটার বয়স ২০-২৫ হবে। নাম জিজ্ঞেস করলেও কোনোমতেই সে তার নাম বলতে রাজি হয়নি। তবে সে জানালো কোনো সখ বা ইচ্ছের বশবর্তী হয়ে সে এ পেশায় নামেনি। বাড়ি নাটোরে। ধর্ষিত হয়েছিল একই গ্রামের যুবকদের হাতে। ধর্ষিত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি কিভাবে হয়েছিল তা সে জানে না। তবে এটুকু জানে, হাসপাতালে তার খবর নিতে বাড়ির গরিব বাবা-মা কেউই আসেননি।
যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল সে। কোনোদিন বাড়ি ফিরে যায়নি। ঢাকায় এসে ২০০৪-এর শেষের দিকে দেহপসারিণী হিসেবে জীবন সংগ্রাম শুরু করেছিল। এখনো চলছে। সর্বোচ্চ ১০ জনের দ্বারাও ধর্ষিত হয়েছিল একবার। প্রায়ই কোনো পারিশ্রমিক পায় না ওরা। সাধারণত ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত পায় প্রতি রাতে। আবার মাঝে মাঝে কন্ট্রাক্ট করে গিয়েও সারারাত ধর্ষিত হয়ে সকালে ফিরতে হয় শূন্য হাতে। আমাদের করা বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলে সে। আমি সবচেয়ে আশ্চর্য ও ব্যথিত হয়েছি, যখন আমি এই লেখাটি লেখা শুরু করেছি। আমার এক বন্ধু লেখার বিষয়টি দেখে আমাকে খুব উৎকণ্ঠা ভরে বললো, ‘তুই শেষ পর্যন্ত এসব নোংরা বিষয় নিয়ে লিখতেছিস’? আমার বন্ধুর কথা বলার ভাবটা এরকম ছিল, যেন এই যৌনকর্মীদের নিয়ে আলোচনা করাই মহাপাপ। ওরা যেন সমাজের উচ্ছিষ্ট, ওরা মানুষ নয়, ওরা পতিতা। আমার বন্ধুকে আমি দোষ দেই না। কারণ এ ধরনের মানসিকতা আমাদের সমাজই ওকে তৈরি করে দিয়েছিল। এটাতো অত্যন্ত ছোট ব্যাপার।
যখন দেখি কোনো নারী ধর্ষিত হয়ে সমাজে চরমভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে সবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, তখন আমাদের এই সমাজের প্রতি ঘৃণা হয়। আমি বুঝি না একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে এ মেয়েটার দোষ কি? ভেবে দেখুন, পরিবার বা সমাজের দায়িত্ব ছিল এ মেয়েটিকে রক্ষা করা। নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু সমাজ কতটুকু নিরাপত্তা দিতে পেরেছে একটা নারীর। আমি একটু কম বুঝি, তাই আমার বুঝতে কষ্ট হয়, যে নারী ১৯৭১ সালে দেশের জন্য জীবন ও ইজ্জত দিয়েছে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক তাকে বীরাঙ্গনা খেতাব দেয়ার পরও যখন তার পরিবার ও সমাজ তাকে চরমভাবে বর্জন করেছিল তখন সে নারীর টানবাজারের পতিতাপল্লীতে যাওয়া ছাড়া আর কিই বা করার ছিল। আমরা কেন বুঝতে চাই না সখ করে কোনো নারী তার জীবনে এ পেশা বেছে নেয় না। মনে রাখতে হবে, যারা এ পেশায় নিজেদের নিযুক্ত করেছে তাদের আর কোনো উপায় ছিল না জীবনকে টেনে নেয়ার।
হয়তো বা এ নারীদের কেউ কেউ সারারাত তার সব শরীর বিকিয়ে দিয়ে সকালবেলা যা পাচ্ছে তা দিয়ে অসুস্থ মা অথবা বাবার জন্য ওষুধ কিনে বাসায় ফিরছে। আবার কেউ কেউ তার ছোট ভাই-বোনের পরীক্ষার ফি জোগাড় করার জন্য খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা শুধু দেখি ওরা কি করে। কিন্তু কেন করে সেটা কি কখনো জিজ্ঞাসা করে দেখেছি? আমাদের ভাবা উচিত ওরা আমাদের মতোই। ওরা সমাজের বিচ্ছিন্ন কোনো অংশ নয়। নিঃসন্দেহে ওদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা উচিত।