আওয়ামী লীগ নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে অস্থিরতার লক্ষণ

নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন মহলের অস্থিরতা এবং নারভাসনেস ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাম্প্রতিক উক্তিতে সেই অস্থিরতা এবং ভীতির আলামত স্পষ্ট ফুটে উঠছে। ১৫ আগস্ট একদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদত দিবস পালিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বেগম জিয়ার ৬৯তম জন্ম
দিবস উদযাপিত হয়েছে। জন্ম দিবসের কেক কাটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দলের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কঠোর মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কেক কেটে খালেদা জিয়া বুঝিয়েছেন যে তিনি এখনও পাকিস্তানের পক্ষে। অন্যদিকে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীতে জন্মদিনের নামে কেট কেটে ফুর্তি করে তাদের সঙ্গে কোন আলোচনা সংলাপ ও আপোষ নেই। তিনি আরো বলেন, তাদের সঙ্গে সংলাপ কখনো সম্ভব নয়। তাদের সঙ্গে কোন আলোচনা বা সমঝোতাও সম্ভব নয়। সৈয়দ আশরাফ আরো বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের শতভাগ ঘৃণা করে। তাদের সঙ্গে কোন আলোচনা হবে না। আওয়ামী লীগের অপর নেতা প্রেসিডিয়াম সদস্য পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, “আমি বলছি এটাই আমার শেষ বক্তৃতা। আর কেউ হরতাল করলে তাদের বাড়িতে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে হবে।” বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ সব কথা বলেন। এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অস্থির রাজনীতি
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল বলেন, আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সেকেন্ড এবং থার্ড ইন কমান্ড পর্যন্ত স্তর থেকে যা বলা হচ্ছে সেগুলো সুস্থ রাজনীতি এবং সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচায়ক নয়। অথচ বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে টেলিভিশন টকশোর একজন প্রখ্যাত আলোচক বলেন যে, জাতীয় শোক দিবসে কেক কাটা কতদূর সঠিক বা বেঠিক সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু সেই কারণে দেশের অপর শীর্ষ নেত্রীর দেশপ্রেম এবং দেশের প্রতি আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা কতদূর সঠিক সেটিও গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। ১৫ আগস্ট জন্মদিনের কেক কাটলেই তিনি পাকিস্তানের পক্ষের লোক হয়ে যাবেন, তেমন বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। দুই দিন আগেই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংকট সমাধানে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। অথচ জন্মদিনের কেক টাকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা আলাপ-আলোচনা সমঝোতা ও সমাধানের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে  দেবেন, সেটা কখনো কাম্য হতে পারে না।
সময় বয়ে যাচ্ছে
রাজনৈতিক মহল বলেন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে সেই সংকট সমাধানের সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সংবিধান অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনী মোতাবেক বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ২৫ জানুয়ারি। সংবিধান মোতাবেক ২৫ জানুয়ারির পূর্ববর্তী তিন মাসের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। অন্য কথায় আগামী ২৫ অক্টোবর থেকে ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। সংবিধানে এ কথাও বলা আছে যে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদ ভেঙে না গেলেও সেটি অকার্যকর থাকবে। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ২৫ অক্টোবর থেকে বর্তমান জাতীয় সংসদের আর কোন অধিবেশন বসবে না। এমন একটি সাংবিধানিক অবস্থায় যদি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয় তাহলে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। সেটি হবে সংবিধানের  ষোড়শ বা ১৬ নম্বর সংশোধনী। সেই কাজটিও করতে হবে ২৫ অক্টোবরের আগেই। তাই ১৮ দলীয় জোটের নির্দলীয় সরকারের দাবি যদি সরকারকে মানতে হয় তাহলে সেটির সাংবিধানিক রূপ দেয়ার জন্য হাতে আছে আর মাত্র ২ মাস ৮ দিন। সময় এতো সংকীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলের সাথে কোন সমঝোতায় উপনীত হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে যেটি অবধারিত সেটি হলো দুই বড় দল তথা দু’টি জোট ও মহাজোটের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘাত।
ড্যান  মজিনার
 দৌড়-ঝাঁপ
আসন্ন রাজনৈতিক সংঘাত এড়াবার জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেছেন। কয়েকদিন আগে তিনি জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ১ ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। গত শুক্রবার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা পুতুলের সাথে সাড়ে ৩ ঘণ্টাব্যাপী বিরতিহীন বৈঠক করেছেন। ড্যান  মজিনা এখানে ব্যক্তি নন। তিনি অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকার প্রতিনিধি। তার চলনে-বলনে এবং আচরণে একটি ভারী ভারীস্থ ভাব থাকবে, সেটাই প্রত্যাশিত। তিনি যেমন ধারে কাটবেন, তেমনি ভারেও কাটবেন। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রী তনয়া পুতুলের সাথে সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময় ধরে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করবেন, সেটি তার প্রোটোকল এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। পুতুল প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং এদেশের একজন সম্মানীয়া নাগরিক। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা হওয়ার সুবাদে তিনি একজন ভিভিআইপিও বটে। কিন্তু তিনি তো কোন মন্ত্রী-স্পিকার বা এ ধরনের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত নন। তার ভাই জয়ের মতো তিনিও তার মাতা শেখ হাসিনা এবং তার মাতার দল আওয়ামী লীগকে মেধা, শ্রম এবং বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যাপার বিশেষ করে গুরুতর রাজনৈতিক সংকট মোচনে ড্যান মজিনা তার সাথে সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে বৈঠক করবেন কেন, সেটি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বোধগম্য নয়। মজিনার ভূমিকা অনেককেই সার্কাসের একটি বিশেষ ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিক্ষিপ্তভাবে যে সব রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে সে সব রিপোর্ট থেকে মনে হচ্ছে যে, ড্যান মজিনা বাংলাদেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের প্রক্সি দিচ্ছেন। তিনি চান, আগামী নির্বাচনে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, এমনকি সেটি যদি বেগম জিয়ার ১৮ দলীয় জোট সরকারও হয়, তাহলেও সেটি যেন ভারতবান্ধব সরকার হয়। জঙ্গিবাদ নির্মূল বলতে তিনি বুঝাতে চান এমনটি ভূমিকা যেটি ইসলাম নির্মূলে পর্যবসিত হয়। ড্যান মজিনা যে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, সেটি বিশ্লেষণ করলে মনে হয় যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে তার সঠিক কোন ধারণা নেই। বাংলাদেশের মাটি এবং জনগণের নাড়ীর স্পন্দন সম্পর্কে তিনি কোন ধারণাই রাখেন না।
মার্কিন ভূমিকা
জনগণের সহায়ক নয়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন কোন দেশের রাজনীতিতে জেঁকে বসে তখন সেই দেশ রসাতলে যেতে শুরু করে। তাদের ভূমিকা হলো বরের ঘরের মাসি আর কনের ঘরের পিসি। মিসরের সাম্প্রতিক রক্তগঙ্গা প্রবাহে আমেরিকার অবদান কোন অংশে কম নয়। মিসরের সেনাবাহিনীর জনবল ৬ লক্ষাধিক। তাদের সজ্জিত করা হয়েছে সর্বাধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে। উদ্দেশ্য হলো, অবাঞ্ছিত রাষ্ট্র ইসরাইলকে মোকাবেলা করা। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত ব্রাদারহুডের মুরসি সরকার উচ্ছেদে মিসরের সেনাবাহিনীকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিল আমেরিকা। সেই মিসরের সেনাবাহিনী যখন ২ সহস্র লোককে হত্যা করেছে, যখন সেখানে জনগণের রক্তের হোলিখেলা চলছে তখন আমেরিকা সেখানে নীরোর বাঁশি বাজাচ্ছে। চূড়ান্ত লক্ষ্য, একটি মুসলিম দেশের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করা এবং সে সেনাবাহিনীকে জনগণের মখোমুখি দাঁড়া করানো।
আজ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ যে সব কথা বলছেন, সেগুলো পরাজয় ভীতির পূর্ব লক্ষণ। এখানে ড্যান মজিনা যদি আদতেই কোন ভূমিকা রাখতে চান তাহলে সেটি হবে দুই নেত্রীকে তথা দুইটি জোটকে আলোচনার টেবিলে বসানো এবং সংকট মোচনের একটি সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা। সেটি না করে তার ভূমিকায় যদি প্রতীয়মান হয় যে, তিনি কোন বিশেষ একটি মহলের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন তাহলে সেটি বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরো সাংঘর্ষিক করে তুলবে এবং ভবিষ্যৎকে আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলবে।-dailyinqilab

Powered by Blogger.