‘আমার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাতাহাতি করে, জাপটে ধরে তখন লাফ দেই’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টাকারী অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মী মাসুমকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রশাসন। স্থায়ীভাবে তাকে বহিষ্কার না করতে নানা
কৌশলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
একই সঙ্গে আগামীকাল শনিবার থেকে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ
কর্মীর শাস্তির দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। বলেছেন, সাময়িক নয়, স্থায়ীভাবেই প্রশাসন তার বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেবেন। অন্যথায় লাগাতার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও একাডেমিক, প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হবে।
ছাত্রীরা জানান, ঘটনাটি জানার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর মনে এই নিয়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ওই রাজনৈতিক কর্মীকে সাময়িক বহিষ্কারের কথা জানিয়েছেন প্রশাসন। অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মীকে ঘটনা থেকে আড়াল করতে প্রশাসনের একটি মহল তৎপর হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে এই বিষয়ে এখনও কোন কথা বলেননি ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা। দলটির সভাপতি এক বিবৃতিতে মাসুমের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে নেয়া যে কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাবেন না বলে জানিয়েছেন।
গত সোমবার সন্ধ্যায় হাটহাজারী থেকে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ওই ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায় ছাত্রলীগ কর্মী মাসুম। তার সঙ্গে ছিল স্থানীয় আরেক বখাটে মোহাম্মদ আলী। সিএনজিতে তারা মেয়েটিকে একা পেয়ে জাপটে ধরে।
পরে এই ঘটনায় মোহাম্মদ আলীকে আটক করা হয়। ঘটনার প্রতিকার চেয়ে পরদিন মঙ্গলবার হাটহাজারী থানায় বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে ছাত্রীটি। পরে বিকালে মাসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, ছাত্রলীগ কর্মীর বহিষ্কারের দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই দলবেঁধে রাস্তায় নেমে পড়ে কয়েক শ’ ছাত্রছাত্রী। এই সময় তারা মাসুমের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন। বেলা ১২টায় ছাত্রীরা শামসুন নাহার হলের সামনে থেকে প্রতিবাদ মিছিল বের করে। পরে প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে মানববন্ধন থেকে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়।
হাটহাজারী থানায় দায়েরকৃত মামলার কপিতে দুর্ঘটনার শিকার মেয়েটি জানান, ‘গত ২০শে মে বিকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে হাটহাজারী থানার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেইট থেকে আমি ক্যাম্পাসের প্রীতিলতা হলের ১২৯ নম্বর কক্ষে যাওয়ার জন্য সিএনজিতে উঠি। আমার সঙ্গে একই গাড়িতে ওঠে বিবাদী মাসুম (২৫) ও মোহাম্মদ আলী (২২)।
মাসুমের পিতার নাম আবু হানিফ। গ্রামের ঠিকানা হাটহাজারীর আমানবাজার, ডাক্তার হামিদের বাড়ি। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার সেশন ২০১১/১২।
তার সহযোগী স্থানীয় বখাটে যুবক মোহাম্মদ আলীর পিতার নাম শেখ ফরিদ ভূঁইয়া। ঠিকানা উত্তর ক্যাম্পাস, এসকিউ/২ নং কক্ষ, চবি।
সিএনজিটি যখন চলতে শুরু করে তখন বিবাদীদ্বয় আমার বুকে শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাতাহাতি করতে থাকে। আমি তাদেরকে আমার গায়ে হাত দিতে নিষেধ করলে তারা আমাকে ভয়ভীতি ও হুমকি দিকে থাকে। একপর্যায়ে বিকাল সাড়ে ৬টায় আমি সিএনজি গাড়িযোগে হাটহাজারীর চবি ক্যাম্পাস রেলক্রসিং এলাকায় পৌঁছলে তারা যৌন নিপীড়ন করার উদ্দেশ্যে আমাকে জাপটে ধরে। এতে আমি চিৎকার করে গাড়ি থেকে লাফ দেই।
বিষয়টি দেখতে পেয়ে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে মাসুম ও আলীকে ধরে ফেলে। পরে আমার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলি। তাদের পরামর্শে থানায় মামলা করছি। এই বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ করছি।’এ বিষয়ে জানতে দুর্ঘটনার শিকার ওই ছাত্রীকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের কোন ঘটনা আর যাতে না ঘটে সেদিকে প্রশাসনকেই নজর দিতে হবে। পথেঘাটে চলাচল করতে গিয়ে যদি বখাটে আর রাজনৈতিক নেতাদের কাছে হয়রানি হতে হয় তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?’ তিনি আরও বলেন, ‘অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মী মাসুমকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের জন্য আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আগামীকাল শনিবার প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করা হবে। তাকে সাময়িকভাবে শাস্তি দিয়ে প্রশাসন ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে চাইছেন।’ সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত উপাচার্য ড. আবু ইউসুফের আমলে এক ছাত্রীকে থাপ্পড় মারার ঘটনায় ছাত্রলীগের বিবিএ অনুষদের এক নেতাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। বাতিল করা হয় তার ছাত্রত্ব। ঘটনাটি জানার পর ছাত্রীরা গত বুধবার এই বিষয়ে প্রশাসনকে স্মারকলিপি দিতে গেলে তাদেরকে ক’জন শিক্ষক অভিযুক্তকে ‘ভাই’ বলে মাফ করে দেয়ার অনুরোধ করেন। পরে ছাত্রীরা বের হয়ে রাস্তায় মিছিল শুরু করলে দুপুরের পর প্রশাসন অভিযুক্ত ছাত্রীর বিভাগীয় প্রধানের বক্তব্য জানতে চান। ওই ছাত্রীর বান্ধবী রুচি ভট্টাচার্য্য, ইয়াসমিন আক্তার, সৈয়দা রোকসাত তাজিন, রওনক জাহান কুমকুম ও গোলাম ইস্পাতুল মাওয়া জানান, ঘটনার পর থেকে মেয়েটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। নানা জায়গা থেকে তার কাছে ফোন আসছে। ঘটনাটি সমঝোতা করার জন্যও কেউ কেউ তাদের চাপ দিচ্ছে। এই বিষয়ে কঠোর কোন সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে। পুলিশ দিয়েও তাদের সেই আন্দোলন দমানো যাবে না। এই বিষয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয় এফ রহমান হলের প্রভোস্ট, শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি আমরা জেনেছি। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রশাসনের কাছ থেকে সময় নিয়েছি। শনিবার আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবো।’ এদিকে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর সিরাজ-উদ-দৌল্লাহ। গতকাল বিকালে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিযুক্ত মাসুমকে সাময়িকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। আর তার সঙ্গে আলী নামের যে ছাত্র ছিল সে বহিরাগত। তার বিষয়ে থানা সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা ঘটনাটি আরও খতিয়ে দেখছি। অভিযোগ গুরুতরভাবে প্রমাণিত হলে হয়তো বড় শাস্তির সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতারা জানান, সিএনজিতে সেদিন আসলে কি ঘটেছিল তা এখনও তারা জানেন না। থানায় মামলা দায়েরের পরপরই পুলিশের কাছ থেকে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে মাসুম ছাত্রলীগের কোন কর্মী কিনা। জবাবে পুলিশকে জানানো হয়েছে তালিকাভুক্ত কোন কর্মী নয় সে। তবে দলের বিভিন্ন মিছিল- মিটিংয়ে তাকে দেখা যায়। ঘটনাটি জানার পর বর্তমানে বিব্রত বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি মামুনুল হক। তবে তিনি ঘটনা সত্য বলে প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত কর্মীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। জানতে চাইলে বলেন, ‘ছাত্রলীগে এখন কয়েক শ’ নেতা-কর্মী। তবে মাসুম নামের যে ছেলেটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তা যদি সত্য হয় তাহলে প্রশাসন যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কেননা, ছাত্রলীগ আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সুসংগঠিত। এখানে বখাটেদের কোন স্থান নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘মেয়েটি যদি আমার বোন হতো তাহলে আমি কি শাস্তি চাইতাম না? অবশ্যই চাইতাম। এই ধরনের ঘটনা ছাত্রলীগ কখনই প্রশ্রয় দেয় না। তবে মাসুম আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন পদে নেই। দলের বেশির ভাগ কর্মী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তার বিষয়ে কোন ধরনের সাফাই না গাইতে।’
 source: হ্যালো-টুডে

, ,
Powered by Blogger.