আসলে কি অ্যাঞ্জেলিনার স্তন তাঁর নিজের নয় ?

ক্যানসারের ভয়ে নিজের দু’টি স্তনই কেটে ফেললেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। আর তাই নিয়ে সরগরম মিডিয়া এবং কফিশপ। চিকিৎসক, বিজ্ঞানীরা মতামত দিচ্ছেন আদৌ স্তন কেটে ফেললেই ক্যানসার ঠেকানো যায় কি না, আদৌ অ্যাঞ্জেলিনার মায়ের মৃত্যু স্তন ক্যানসারেই হয়েছিল কি না। মতামতগুলো জরুরি, ক্যানসারের মতো একটা রোগ সম্পর্কে সত্যি আশঙ্কা আর মিথ্যে আশাগুলোকে আরও পরিষ্কার করে দেখার জন্যই। কিন্তু জনান্তিকে একটা প্রশ্নও উঠছে, সত্যিই কেন এত উত্তাল মিডিয়া? আসলে অ্যাঞ্জেলিনার স্তন তাঁর নিজের নয়, গণঔৎসুক্যের কেন্দ্র বলেই কি বিশ্বের অধিকার তার উপরে? তাই এত হতাশা, যেন কেটে ফেলল, ইসস তার আগে এক বার বলল না!
অথচ, ঠিক হোক, ভুল হোক, নিজের স্তন নিয়ে অ্যাঞ্জেলিনা কী করবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার তো তাঁরই। অধিকার নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ প্রশ্ন তুলছে না বটে, সেটা তোলা যায়ও না, কিন্তু তর্ক-বিতর্কের মধ্যে ওই চাপা দীর্ঘশ্বাসটাও নজর এড়াচ্ছে না। আর তখনই চিন্তার একটা সূত্রে এই চূড়ান্ত সেলিব্রিটির চড়া আলোর কোনও এক অন্ধকার কোনায় এসে দাঁড়াচ্ছেন রতিমঞ্জরী, বিধবা রতিমঞ্জরী।
সেই বিধবা রতি, যে নিজের পুনর্বিবাহের জন্য বিজ্ঞাপন দেয় কাগজে। আর তার পর তার মনে হয়, ‘সবাই বলছে দেবতাকে ডাকো, দেবতাকে জানো, দেবতাকে ভালোবাসো, দেবতাকে ঘরে আনো, দেবকাহিনী বলো আর শ্রবণ করো। মানুষকে ডাকতে কেউ বলছে না।…’ রতির সে বিজ্ঞাপনের উত্তরে আসেনি কোনও মানুষ, আসেনি দেবতাও, এসেছিল এক বিপত্নীক, নিজের আর তার বাচ্চাগুলির সেবাদাসীর খোঁজে। রতি তাকে অকপট বলেছিল, ‘বিয়ে করে স্ত্রীকে দিয়ে আপনি কেবল সুলভ গণিকাবৃত্তি করিয়েছেন।’ ব্যর্থ রতির মনে হয়েছিল, ‘তার গণিকাবৃত্তিই পৃথিবী চায়… গণিকাই সে হবে।’
এই সিদ্ধান্ত অভিমানের ফসল। আজকের দিনে গণিকা হওয়া বা নিজের শরীরকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করার পিছনে অভিমান আর তত কাজ করে না, যতটা করে অধিকারবোধ। নিজের শরীরের উপরে সেই অধিকারবোধ উদ্‌যাপন করার মতো। যে অধিকারবোধে লাস ভেগাসে বিবিধ ধারার পর্নো-ছবিতে রীতিমতো পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিজের অর্জিত শরীরকে ব্যবহার করেন স্টার পর্নো-অভিনেত্রীরা। কিন্তু সেই অধিকারবোধ মিডিয়ায় যে বহুল চর্চিত হয় সেটা যত না তাকে সম্মান করে তার চেয়ে অনেক বেশি সেই চর্চায় আরও অনেক উঁকি-মারা মানুষের খিদে মেটে বলে। ক্ষমতার এও এক খেলা। সেলাম কাকে দেব, কোন সেলাম কতটা খাবে সেই বিচারের খেলা।
সাম্প্রতিকে তাই বার বার উঠে আসেন সাহিত্যে ক্ষমতার খেলায় একদা-পর্যুদস্ত এক লেখক, জগদীশ গুপ্ত, যিনি তৈরি করেছিলেন বিধবা রতিমঞ্জরীকে, প্রায় সাত দশক আগের বাংলা গল্পের ভুবনে। তিনিই আবার তৈরি করেন ‘পাইক শ্রীমিহির প্রামাণিক’-কে। ক্ষমতার স্তরভেদ, সেলাম পাওয়া আর সেলাম দেওয়ার অন্তর্গত যে খেলা তাকে এত স্পষ্ট করে, এত মর্মভেদী করে আর ক’জন বলতে পেরেছিলেন আজ থেকে ছ’দশক আগে? মেয়েদের গণিকাবৃত্তিই পৃথিবী চায়, এবং চায় না যে সেই চাওয়াটাকে কেউ আঙুল তুলে দেখিয়ে দিক। বাংলা সাহিত্যে সেই চোখে আঙুল তুলে দেখাবার সাহসটাই বার বার দেখিয়েছিলেন জগদীশ গুপ্ত।
সেই না-আপোষ লেখক তার জন্য দামও দিয়েছেন। ভাবনায় সেই উলটযাত্রাটাই তাঁর কাল হয়েছিল। সমকাল তাঁকে নিল না। অনন্ত কালের, বিপুল পৃথিবীর কোনও অনাগত সমানধর্মার অপেক্ষায় মৃত্যু ঘটল কঠোর দারিদ্র্যে। পেলেন না কোনও পুরস্কারও।
না-ই বা পেলেন, এ কালের পরিবর্তিত মূল্যবোধেও যে তিনি সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে রইলেন, তা-ই বা কম কীসে?

,
Powered by Blogger.