পুলিশ বাহিনীতে যুক্ত হচ্ছে ৬ কোটি টাকার ২টি বুলেটপ্রুফ গাড়ী

পুলিশের সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টিম সোয়াটে (স্পেশাল ওয়েপনস অ্যান্ড ট্যাক্টিকস) যুক্ত হচ্ছে ৬ কোটি টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক ২টি বুলেটপ্রুফ গাড়ি আর্মারড ফোর্ড’। ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান ও জিম্মিদশা থেকে কোনো ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে এ গাড়ি ব্যবহার করা হবে। উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতি বছরেই আমেরিকার এলপিন আরমোরিং কোম্পানির তৈরি অত্যাধুনিক এ গাড়ি সোয়াটের
হাতে তুলে দেয়া হবে। বাংলাদেশের কোনো বাহিনীর কাছে এটাই প্রথম কোনো অত্যাধুনিক গাড়ি। পাশাপাশি সোয়াটে জনবল বাড়ানোরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, সোয়াটকে শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে এর আগে জার্মানি থেকে ক্রিস সুপার ভি সাবমেশিন ও ৫০ হাজার গুলি কেনা হয়। সমুদ্র পথে আসছে এই বিশাল অস্ত্র ও গুলির চালান। চলতি মাসের শেষের দিকেই এই অস্ত্র ও গুলির চালান পেঁৗছানোর কথা রয়েছে। সোয়াটের দায়িত্বপ্রাপ্ত এডিসি আশকুর রহমান যায়যায়দিনকে জানান, আমেরিকার এলপিন আরমোরিং কোম্পানির বুলেটপ্রুফ গাড়িটি কেনার সিদ্ধান্ত হয়। গাড়িতে যাত্রীর বসার আসনসহ চারপাশের ধাতব সাধারণ পদার্থগুলো পরিবর্তন করে শ’খানেক ব্যালিস্টিক স্টিল লাগানো রয়েছে। গাড়ির ছাদ ও নিচের অংশে শক্তিশালী বিস্ফোরকসহ, (এন্টি মাইন ও উগ৫১ গ্রেনেড) সব ধরনের বিস্ফোরক প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকবে। গাড়িতে বহুস্তর বিশিষ্ট বিস্ফোরক প্রতিরোধক কাচ বসানো রয়েছে, যা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রাইফেলের গুলিও ঠেকাবে। এটিতে অতিরিক্ত তেলের ট্যাংক, ব্যাটারি ও কম্পিউটার মডিউল থাকবে। গড়িতে বহু সাইরেন ব্যবস্থা ও লেড স্ট্রোব লাইট থাকবে। ব্যবহারকারীর ইচ্ছা ও সুবিধা অনুযয়াী অতিরিক্ত ভরসহনীয় দরজা থাকবে। আন্ডারক্যারিয়েজে শ’খানেক অতিরিক্ত বিস্ফোরক প্রতিরোধক স্টিল বসানো থাকবে। নির্দিষ্ট দরজায় ও জানালায় গানপোর্টস স্থাপন করা থাকবে। গাড়িতে বসেই শত্রুপক্ষকে পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যামেরা ও স্বয়ংক্রিয় পর্যবেক্ষক থাকবে। পাশাপাশি গাড়িতে ফোর গ্রেড মানের সামরিক হুইলের সেট থাকবে। একই সঙ্গে ব্যবহারকারীদের ইচ্ছার ওপর গাড়িটি বিশেষায়িত করা যাবে। তিনি আরো বলেন, এ কোম্পানির গাড়ির চাকা থেকে শুরু করে সবকিছুই বুলেটপ্রুফ। গাড়িতে বসেই শত্রুপক্ষকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া যাবে। এক সঙ্গে ৪ জন সোয়াট সদস্য চারদিক থেকে শত্রুপক্ষকে লক্ষ করে গুলি ছুড়তে পারবে। গাড়িটি ঘণ্টায় দেড়’শ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম। যদি কোনো কারণে এই গাড়ির চাকার হাওয়া বেরিয়ে যায় তারপরও গাড়িটি ৫০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে পারবে। ৭ হাজার ৫২৯ কেজি ওজনের গাড়িতে ১০ জনের আসন রয়েছে। ১ জন চালক ও একজন সহকারী গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ করবে। গাড়িটির পেছনের দিকে ৮ জন সদস্য বসতে পারবেন। এছাড়া গাড়িতে ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করা যাবে। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংরক্ষণের জন্য জন্য আলাদা একটি নিরাপদ স্থান রয়েছে। একেকটি গাড়ির আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। পৃথিবীর ৪টি দেশ চীন, সুইডেন, জার্মান ও আমেরিকা এ ধরনের গাড়ি বানিয়ে থাকে। এই চার দেশের মধ্যে আমেরিকার এলপিন আরমোরিং কোম্পানির গাড়ি বেশি প্রযুক্তি সম্পন্ন। এই গাড়িকে লক্ষ করে যদি শত্রুপক্ষ খুব কাছ থেকেও রাইফেল, সাব মেশিনগান, এসএমজি ও পিস্তল দিয়ে গুলি করে, তারপরও গাড়ি অক্ষত থাকবে। মূলত জিম্মিদশা থেকে কোনো ভিআইপিকে উদ্ধার ও বড় ধরনের কোনো নাশকতা বানচাল করতেই এই গাড়ি ব্যবহার করা হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো সময় দেশের কোনো ভিআইপি যদি কারো দ্বারা জিম্মি হয় তাহলে এই গাড়ি নিয়ে অভিযান চালানো হবে। এ ধরনের জিম্মিদশা থেকে সোয়াটের ২০ জন সদস্য দুটি গাড়ি নিয়ে খুব অনায়াসেই জিম্মি ব্যক্তিকে মুক্ত করতে পারবে। তিনি আরো বলেন, যদিও বাংলাদেশে এই ধরনের কোনো ঘটনা এখনো পর্যন্ত ঘটেনি। তারপরও অগ্রিম প্রস্তুতি হিসেবে এই ব্যবস্থা নিয়ে রাখা। পাশের একটি দেশের হোটেলে জিম্মি ঘটনার কথা মনে করিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে যদি কখনো এই ধরনের ঘটনা ঘটে তাহলে পার্শ্ববর্তী দেশের মতো জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেক্ষেত্রে এক ঘণ্টার অভিযানে সব জিম্মি ব্যক্তিকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। শত্রুপক্ষ ভারি অস্ত্রে সজ্জিত থাকলেও এই গাড়ি নিয়ে তাদের দমন করা খুব সহজ হবে। মূলত সন্ত্রাসীদের কাছাকাছি পেঁৗছাতে এই গাড়ি সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হবে। একমাত্র সেনাবাহিনীর ট্যাংক এই গাড়িকে ধ্বংস করতে সক্ষম। এর বাইরে কোনো ধরনের ভারি অস্ত্র এই গাড়ি ধ্বংস করতে পারবে না। জানা গেছে, সোয়াট টিমে বর্তমানে ৩ জন এডিসি (অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার) ৩ জন ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) ৫ জন এসআই (সাব-ইন্সপেক্টর), ৩ জন সার্জেন্ট ও ৪ জন এএসআইসহ মোট ৫০ জন সদস্য রয়েছে। উল্লেখ্য, আমেরিকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সোয়াট টিমের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বর্তমানে এই বাহিনী আমেরিকায় তৈরি অত্যাধুনিক এম ফোর রাইফেল এবং বস্নক-১৭ পিস্তল দিয়েই অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু এম ফোর রাইফেল ভারি হওয়ায় বহন করা কষ্টকর। তাই এ অস্ত্র হাতে নিয়ে দীর্ঘ অভিযান পরিচালনা করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এজন্য জার্মানির তৈরি ক্রিস সুপার ভি সাব মেশিনগান কেনা হয়েছে। মূলত জিম্মি ব্যক্তিকে উদ্ধার, জঙ্গি হামলা মোকাবেলা ও ছিনতাইকৃত বিমান উদ্ধার করার প্রশিক্ষণ নিলেও গত চার বছরে এ টিম ২১ ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে শোডাউন ছাড়া আর কোনো কর্মতৎপরতা দেখাতে পারেনি। সোয়াট টিমের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাবি, সন্ত্রাসীদের হাতে ভিভিআইপি জিম্মি হওয়াসহ এ ধরনের যেকোনো সঙ্কটময় পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এ টিমকে সব সময় প্রস্তুত রাখা হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল সোয়াট বাহিনী। বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলাকালে দুষ্কৃৃতিকারীরা কোনো স্টেডিয়ামে ঢুকে দর্শকসহ খেলোয়াড়দের জিম্মি করলে কীভাবে তাদের দ্রুত জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে হবে তার মহড়ায় অংশ নিয়েছিল সোয়াট বাহিনী। জানা গেছে, সোয়াটের অগ্রগতি খতিয়ে দেখছেন আমেরিকার ‘অ্যান্টি টেরোরিজম অ্যাসিসটেন্স (এটিএ)’ প্রোগ্রামের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা। তারা সব সময় সংশ্লিষ্ট টিমের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ রাখছেন। পাশাপাশি বছরে দুই বার তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সোয়াটের কার্যক্রম জানতে ঢাকায় আসে। বিভিন্ন সময়ে এ প্রতিনিধি দলের কাছে সোয়াটকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সহযোগিতা চাওয়া হয়। সূত্র জানায়, ‘অ্যান্টি টেরোরিজম অ্যাসিসটেন্স (এটিএ)’ এর আওতায় ২০০৮ সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বাছাইকরা ২৮ জনের একটি টিমকে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকা পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে আমেরিকার পক্ষ থেকে এই টিমের জন্য প্রায় ১২ কোটি টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক অস্ত্র, গুলি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় মূল্যবান সরঞ্জামাদি দেয়া হয়, যা উন্নত দেশে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ অভিযানে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বিগত বছরেও আরো কিছু অস্ত্র গুলি এই টিমকে দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পর এই সদস্যদের নিয়ে সোয়াট নামে গোয়েন্দা পুলিশের এই বিশেষ ইউনিট গঠন করে। পরে এ টিমে আরো ২২ জন সদস্য বাড়ানো হয়। আমেরিকা থেকে নিজেদের প্রশিক্ষক ঝালিয়ে নেয়ার জন্য প্রতি মাসে এক টাঙ্গাইলে সোয়াটের সদস্যরা মহড়া ও ফায়ারিং করে থাকেন।

Powered by Blogger.