বন্ধ হয়ে গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্বার

ভিসা জালিয়াত চক্রের কারণে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্বার। এসব জালিয়াত চক্রে কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সি ছাড়াও রয়েছে, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কিছু অসাধু কর্মকর্তা, বিমানবন্দরে কর্মরত ইমিগ্রেশন পুলিশ
এবং বিমানবন্দরে নিয়োজিত বিমান সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কর্মী, যারা আইএনএস নামে পরিচিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএমইটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভিসা জালিয়াতির বিষয়টি অনেক আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু তারপরেও এর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বিমান সংস্থাগুলোর নিয়োজিত প্রধান নিরাপত্তাকর্মী এবং বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে জাল ভিসায় আরব আমিরাত যাচ্ছেন লোকজন। এ জালিয়াত চক্র জনশক্তি রপ্তানির নামে মানব পাচার করে অবৈধ পথে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অন্যদিকে তাদের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন শতশত নিরীহ মানুষ। এ অবস্থা চলতে থাকলে শুধু আরব আমিরাতই নয়; আগামীতে ব্রুনাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক দেশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আশঙ্কা রয়েছে। জানা গেছে, কোনো ব্যক্তি চাকরি নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশে যেতে চাইলে প্রথমে তাকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দারস্থ হতে হয়। রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ভিসা পাওয়ার পরে তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সহযোগিতা চেয়ে ভিসাসহ পাসপোর্ট জমা দেয়া হয়। ভিসা সঠিক কিনা তা জানতে সাহায্য করে বিএমইটি। বিএমইটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভিসা যাচাই-বাছাই করে পরে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের মতো একটি কার্ড ধরিয়ে দেয় ভিসাধারী ব্যক্তিকে। এই কার্ডকে ‘স্মাট কার্ড’ বলা হয়। তখন স্মার্ট কার্ডধারী ব্যক্তি নিশ্চিত হন যে তার ভিসা সঠিক। এর পরে নির্দিষ্ট সময়ে ওই ব্যক্তি বিমানবন্দরে চলে যান। বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে বিমানে ওঠার পূর্ব মুহূর্তে সর্বশেষ নিরাপত্তা চেকিংয়ে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মীরা আবারো পাসপোর্ট ও ভিসা চূড়ান্তভাবে খতিয়ে দেখে যাত্রীকে বিমানে ওঠানোর ছাড়পত্র দেয়। এরপর যাত্রী চলে যান দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কিন্তু বিমানবন্দরে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে ধরা পড়ে জাল ভিসার বিষয়টি। এরপর যাত্রীকে আটক করে এবং ওই যাত্রীর সঙ্গে রিটার্ন টিকিট থাকলে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর রিটার্ন টিকিট না থাকলে সে দেশের আইনানুযায়ী জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয় যাত্রীকে। এরপর মাসের পর মাস কাটাতে হয় ভিনদেশী কারাগারের অন্তরালে। আর ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তাদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা । রাজধানীর বনানী, মতিঝিল, নয়া পল্টন এলাকার কিছু রিক্রুটিং এজেন্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ভিসা জাতিয়াতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বলে জানতে পেরেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এসব রিক্রুটিং এজেন্সের একটি হলো ‘বায়তুল্লাহ ওভারসীজ’। এই প্রতিষ্ঠানটি বিএমইটি থেকে ১৫টি ভুয়া স্মার্টকার্ড নিয়েছে বলে অভিযোগ করে বিএমইটি কর্তপক্ষ গত ৪ অক্টোবর ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে একটি চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে। ভূয়া স্মার্ট কার্ডধারী ব্যাক্তিরা যেন বিমানে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইমিগ্রেশন পুলিশকে নির্দেশও দেয়া হয় ওই চিঠিতে। জানা গেছে বিএমইটি কর্তৃপক্ষ ইমিগ্রেশন পুলিশকে ওই চিঠি দিয়েছে আমিরাত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা স্থগিত ঘোষণার পরে। নিজেদের গা বাঁচানোর জন্যই বিএমইটি এই চিঠি দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। বিএমইটি কর্তৃপক্ষ এই ভিসা জালিয়াতির বিষয়টি অনেক আগে থেকেই জানত এবং বিএমইটির অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যুক্ত। ফলে পুরো বিষয়টি তারা কৌশলে চেপে যান এবং কোনো ব্যবস্থা না নেয়া থেকে বিরত থাকে বলে অভিযোগ ওঠেছে। বাংলাদেশিদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা স্থগিতের ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেচারালাইজেশন অ্যান্ড রেসিডেন্সি অ্যান্ড পোর্ট এফেয়ার্স বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি মেজর জেনারেল নাসের আল আবাদী আল মেনহালি গত ৪ সেপ্টম্বর গালফ নিউজকে বলেছেন, গত ৮ মাসে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি জাল ভিসা নিয়ে আমিরাতে প্রবেশের চেষ্টা করেছে। যারা এ অবৈধভাবে ঢোকার চেষ্টা করেছে তাদের ধরা হয়েছে। এ কারণে সাময়িকভাবে বাংলাদেশিদের আমিরাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ভিসা প্রদান বন্ধ রাখা হয়েছে। জাল ভিসায় আমিরাতে আসা বন্ধ হলে আবার ভিসা প্রদান চালু করা হবে বলেও জানান মেনহালি। বিএমইটির বহির্গমন ও প্রটোকল শাখার পরিচালক মিজানুর রহমান এ বলেন, আমিরাত সরকার বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ করেনি। আগে যে হারে ভিসা দেয়া হতো, এখন আর সেই হারে দিচ্ছে না। অক্টোবর মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত আমিরাত সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা দিয়েছে। আমিরাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ভিসা পাওয়া পাসপোর্ট নাম্বার ও ভিসা নাম্বার এটাসস্টেশন করে বিএমইটির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর জাল ভিসার ব্যাপারে বিএমইটি অবহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। ইমিগ্রেশন পুলিশকে লিখিতভাবে অবহিত করে।

Powered by Blogger.