ডিআইজিসহ ৮ জনের আগুনে পুড়ে মরার ঘটনাটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড!

৩ মাসের মাথায় রহস্য উদঘাটন
৩ মাস আগে রাজধানীর মিরপুরের তুং হাই স্যুয়েটার্সে কোনো মামুলি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেনি। সুপরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। অগ্নিকান্ডের আড়ালে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি জেড এ মোরশেদ, তুং হাই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ-এর পরিচালক মাহবুবুর রহমানসহ ৮ জনকে হত্যা করা হয। গত ৩ মাসের অনুসন্ধানে এ সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাহবুর রহমানের স্ত্রী ও তুংহাই গ্রুপের একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলে হত্যার নীলনকশা করে। এর মধ্যে অর্থ আত্মসাৎ, মাহবুবুর রহমানের দ্বিতীয় বিয়ে এবং প্রথম স্ত্রী আঞ্জুমান আরা খানমের সঙ্গে ডাঃ এহসানের গোপন সম্পর্ক হত্যার নেপথ্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেছে মাহবুবুরের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা খানম ও ইডি ডাঃ এহসান। তাদের সহযোগিতা করেছে তুং হাই স্যুয়েটার্সের কন্ট্রোলার সাত্তার ও সিকিউরিটি ইনচার্জ কুদ্দুছ এবং মাহবুবুর রহমানের বন্ধু ইকবাল।
গত ৮ মে বুধবার দিবাগত রাত পৌঁনে ১১টায় ৩০/২ দারুসসালাম রোডস্থ তুং হাই স্যুয়েটার্স লিমিটেড নামের ১১ তলা ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। রাত দেড়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। পরের দিন ভোর ৫টায় অগ্নিনির্বাপনের কাজ সম্পন্ন হয়। এ ঘটনায তুং হাই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত ডিআইজি জেড এ মোরশেদ ছাডাও, কুমিল্লা (উঃ) জেলা যুবলীগ সভাপতি সোহেল মোস্তফা ভূঁইয়া ওরফে স্বপন, মাহবুবের ব্যক্তিগত বন্ধু বাদল, ব্যক্তিগত সহকারী নাজু, তুং হাই গ্রুপের অফিস পিয়ন সাহাবুদ্দিন, অতিরিক্ত ডিআইজি’র দেহরক্ষী পুলিশ সদস্য রতন চাকমা ও রং মিস্ত্রি সুলতানের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
রহস্যজনক অগ্নিকান্ডের কয়েকটি ধাপ
উদ্ধার কর্মীরা জানান, আগুন লাগার প্রায় ২০ মিনিট পরে ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজে বাংলা কলেজের বেশ কয়েকজন ছাত্র এগিয়ে আসে। কিন্তু তুং হাই গ্রুপের নিরাপত্তা প্রহরীরা গেট খুলে দেয়নি। পরে তারা দেয়াল টপকে ভেতরে গিয়ে গেট খুলতে বাধ্য করে। একই সঙ্গে ৩ তলায় আগুন নেভানোর কাজে লেগে যায়।
এছাড়া দমকল বাহিনীর সদস্যদের অগ্নিনির্বাপনে তুং হাই গ্রুপের নিরাপত্তা প্রহরীরা কোনো প্রকার সহায়তা করেনি। কোথায় পানির হোস, কোথায় ফায়ার এক্সিট ইত্যাদি কোনো বিষয়ে উদ্ধারকর্মীদের তথ্য দেয়া হয়নি। এমনকি ভবনের ভেতরে কেউ আছে কি-না সে প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো জবাব দেয়নি তুং হাই গ্রুপের নিরাপত্তা প্রহরীরা। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর রাজধানীতে হরতাল ডিউটিতে নিয়োজিত বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি), র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসার পরে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ পুরোদমে শুরু হয়।
ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের স্টেশন মাস্টার শহিদ বলেন, তুং হাই স্যুয়েটারের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসকে বিভ্রান্ত করা হয়। প্রথমে খবর দেয়া হয় আগুন ধরেছে। পরে বলা হয় আগুন নিয়ন্ত্রণ এসেছে। এ সময় ফায়ার সদর দফতর থেকে ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে যাওয়া দমকল বাহিনীর সদস্যরা ফিরে আসে। আবার খবর আসে আগুন পুনরায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। পরে দমকল বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে আগুন নিযন্ত্রণ করে।
ঘটনার সময় সরেজমিনে দেখা যায়, আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজের পাশাপাশি উদ্ধার কাজ শুরু হয়। সেখানেও সূচনা হয় নতুন রহস্যের। ৩ তলায় আগুন লাগার পর ৮ তলা ও চার তলা থেকে ১১ জন লোক নিরাপদে বেরিয়ে আসে। অথচ ১০ তলায় অবস্থানরত ৮ জনের ১ জনও বাঁচতে পারেনি। আগুন লেগেছিলো ৩য় তলায় আর নিহতদের লাশ পাওয়া গেছে ৮ম তলা থেকে ১১ তলা পর্যন্ত। এমনকি মাহবুবুর রহমানের পিয়ন সাহাবুদ্দিন ও একজন রং মিস্ত্রি ছিলেন ১০ তলাস্থ রান্নাঘরে ও পুলিশ কর্মকর্তা মোরশেদের ড্রাইভার রতন চাকমা যে রকম রিসেপশনের সোফায় বসেছিলেন সেরকম অবস্থায় সোফার পাশ থেকেই তার লাশ উদ্ধার করার বিষয়টি রীতিমতো বিস্মযকর!
যদি আগুনের খবর পেয়ে ১০ তলা থেকে নিচতলায় ঐ ব্যক্তিরা নেমে আসেন তাহলে ওপরে আর উঠতে পারবেন না। কারণ ধোঁয়ার মধ্যে তারা মৃত্যুবরণ করবেন। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহা-পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, তুং হাই স্যুয়েটারের আগুনে ধোঁয়া বিষাক্ত ছিল। তারা সিঁড়িতে আসার কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখানেও প্রশ্ন থেকে যায় মৃত ব্যক্তিরা কিভাবে ওপরে উঠল। অপরদিকে ৩ তলায় আগুন লাগার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ১০ তলায় অবস্থানকারী সকলে মৃত্যুবরণ করা অসম্ভব।
একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা ও মাহবুবুর রহমান নিজে দুর্ঘটনাকালীন সময়ে আত্মরক্ষার কৌশল সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তুং হাই স্যুয়েটার্স ভবনটি একটি শতভাগ কমপ্ল্যায়েন্ট কর্মস্থল। ঘটনার সময় পেছনের জরুরি নির্গমন সিঁড়ির ছাদের দরজা খোলা ছিলো। সামনের সিঁড়ির ছাদের গেটও খোলা পাওয়া গেছে বলে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে ৮ম তলা থেকে নেমে যাওয়া লোকদের বাংলা কলেজের হোস্টেলের ছাত্ররা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছে।
অগ্নিকান্ডের আগে ও পরে যা ঘটেছিল
ঢাকায় অবস্থানকালে মাহবুবুর রহমান প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তার অফিসে রাজনৈতিক ও সামাজিক আড্ডা দিয়ে আসছিলেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে আওযামী লীগ থেকে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন তিনি। ঐ আড্ডায় জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতারা অংশ নিতেন।
ঘটনার শিকার জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা মোরশেদ ছিলেন মাহবুবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে সূত্র ধরে তিনি প্রতিনিয়ত এখানে আসতেন। ঘটনার রাতে মাহবুব তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ৪ বন্ধুকে নিয়ে ভবনের অফিস ব্লক ১০ তলায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় ৮ তলায় ৭ জন রং মিস্ত্রি এবং ৪ তলায় ৪ জন বারটেক্ অপারেটর ডিউটিরত ছিলেন। ৭ জন রং মিস্ত্রির মধ্যে ৭ জন এবং ৪ জন অপারেটরের মধ্যে ৪ জনই আগুন লাগার পর ভবন থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ ভবনের ১০ তলায় অবস্থানরত মাহবুবুর রহমান এবং তার সঙ্গীরা কেউ ভবনের পেছনের দিককার জরুরি অগ্নি নির্গমন সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারেননি।
হত্যার পরিকল্পনা ও অগ্নিকান্ডের নাটক
অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, মাহবুবের সঙ্গে তার পরিবাবের বৈরি সম্পর্ক ছিলো। এমনকি তুং হাই কোম্পানিতে চাকরিরত আপন ভাই নাজুকে দু’দুবার চাকরিচ্যুত করেছিলে মাহবুব। তাতে ক্ষুব্ধ থাকার কারণে নাজুকে কাছে টানেন মাহবুবের স্ত্রী। আর হত্যাকারীদের প্রধান পরিকল্পনাকারী হলেন ডাঃ এহসান। তাদের সহায়তা করে সাত্তার ও ইকবাল গং।
হত্যার পরিকল্পনার মধ্যে অতিরিক্ত ডিআইজি জেড এ মোরশেদ ছাড়াও কুমিল্লা (উঃ) জেলা যুবলীগ সভাপতি সোহেল মোস্তফা ভূঁইয়া ওরফে স্বপনকে রাখা হয়। কারণ তারা ২ জন মাহবুবুরের সম্পদ ও অনেক ঘটনা সর্ম্পকে জানতেন। তারা জীবিত থাকলে হত্যাকারীরা সহসা পার পাবে না বলে তাদের হত্যা করা হয়।
তুং হাই গ্রুপের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, পরিকল্পনা অনুসারে মাহবুবুর রহমানের অবস্থানস্থল ১০ তলায় বিষাক্ত গ্যাস বা গ্যাস জাতীয় কিছু দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। এ জন্য ভাড়াটে পেশাদার খুনিচক্রকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তারা রং মিস্ত্রি হিসেবে ভবনে প্রবেশ করে এবং ১০ তলায় অবস্থানরত সবাইকে হত্যার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। বিষাক্ত গ্যাস ১০ তলায় ব্যবহৃত হওয়ার প্রধান প্রমাণ, ১০ তলায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা না ঘটলেও ঐ স্থানে পোকা-মাকড় থেকে শুরু করে ইঁদুর পর্যন্ত জীবিত ছিল না। অনেক প্রাণী মরা অবস্থায় দেখা গেছে।
গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে, অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটার পর ভিক্টিমদের কেউ কারোর সাথে ল্যান্ড বা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেননি। আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে আসা ব্যক্তিরাও ভিক্টিমদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়াও মাহবুবুরের চোখের ডানপাশে ও গালের ওপরের অংশে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে বলে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়।
হত্যাকাণ্ডের রহস্য সম্পর্কে মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ইমতিযাজ আহম্মেদ বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনার রহস্য এখনো উদঘাটন হয়নি। পুলিশের মিরপুর বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনারকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞদের মতামত ও ময়না তদন্ত রিপোর্ট হাতে না পাওয়া তদন্ত শেষ হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি ইমতিয়াজ বলেন, তিন তলায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, অথচ আটতলা বা তার ওপর তলাগুলোতে লাশ পওয়া গেছে। এটা রহস্যজনক। যদি হত্যার কোনো ঘটনা ঘটে তাকে তা অবশ্যই প্রকাশ পাবে। এ ঘটনায় আরো কয়েকটি গোয়েদা সংস্থা ও ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করছে। সবার তদন্ত শেষ হলে আসল রহস্য উদঘাটন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা খানম কোনো তথ্য দিতে রাজি নন। গত শুক্রবার বিকেলে তার মুঠোফোনে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। এ সময় তাকে প্রশ্ন করা হয়- তার স্বামীর কি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে? ডাঃ এহসানের সঙ্গে তার কি সর্ম্পক। রং মিস্ত্রি হিসেবে তিনি কাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। এসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি মোবাইল ফোন সংযোগ বিছিন্ন করে দেন। এর পরে শনিবার সারা দিন তার ফোনে রিং হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি।
ডাঃ এহসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ শুনে মোবাইল ফোনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তুং হাই স্যুয়েটার্সের কন্ট্রোলার সাত্তার বলেন, মাহবুবুর রহমান ছিলেন তার বাবার মতো। কোনো সন্তান তার বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে না। সূত্র : শীর্ষ নিউজ

Powered by Blogger.