ঐশী একা নয়, আমরাও খুনি

ঐশীর ছেলেবেলায় কোনও জ্যোতিষী যদি তার বাবা-মাকে নক্ষত্রগণনা করে বলে দিতে পারতেন যে, একই দিনে একই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হবে দুজনের, আমি নিশ্চিত, দুজনই একসঙ্গে আঁতকে উঠে বলতেন, ‘আমাদের ঐশী সোনামণির কিছু হবে না তো?’— না, বাবা-মা দুজন একসঙ্গে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও ঐশীর কিছু হয়নি। কিন্তু যে-ভাবে এই ‘না-হওয়া’, তাতে সবাই স্তম্ভিত ।

দুই.
১৬ বছর বয়সী মেয়ে ঐশী ও তার বন্ধুদের হাতে খুন হয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রী স্বপ্না। হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার একদিন পর নিখোঁজ ঐশী নিজেই ধরা দিয়েছে পুলিশের হাতে। তার ভয় হচ্ছিল, খুনি-বন্ধুরা নিজেদের বাঁচাতে তাকে হত্যা করতে পারে। গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দি থেকে প্রাথমিকভাবে এ তথ্যই উঠে এসেছে যে, মাদকাসক্তিসহ উচ্ছৃক্সখল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিল ঐশী। সেই জীবনের রাশ টেনে ধরতে চাওয়াই কাল হয়েছে বাবা-মার। পুলিশ বলছে, খুনের সময় অকুস্থলেই ছিল ঐশী। হতে পারে, এটাই সত্য এবং মেয়েই বাবা-মার খুনি। আবার না-ও তো হতে পারে। অপরাধীর প্রাথমিক জবানবন্দি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার ভূরি-ভূরি দৃষ্টান্ত আছে জগতে। সত্যের গভীরে থাকা সত্য উন্মোচনে ঐশীকে আদালতে উপস্থাপন করে তাকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রার্থনা করে পুলিশ। আদালত সে-প্রার্থনা মঞ্জুরও করেছেন। রিমান্ড শেষে হয়তো অনেক সত্যই পূর্ণ অবয়বে উন্মোচিত হবে। দোষী প্রমাণিত হলে আদালত ঐশীকে কী শাস্তি দেবেন জানি না— প্রশ্ন এই যে— আমরা যারা ঐশীকে খুনি বানিয়েছি, তাদের শাস্তি দেবে কে?
ঐশী এখন পুলিশ রিমান্ডে। তাকে কতরকম জেরাই না করা হবে। আমরাও যদি বিবেকের রিমান্ডে যাই, এ সত্যই বেরিয়ে আসবে যে— ঐশী একা নয়, এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে আমরা সবাই জড়িত। আমরা সবাই খুনি।
তিন.
মাহফুজ-স্বপ্না হত্যাকান্ডে ঐশীকে প্ররোচিত করেছি আমরা সবাই। এ হত্যাকান্ড আমাদের সামষ্টিক দায়। প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, মূল্যবোধহীন শিক্ষাব্যবস্থা, দিককানা গণমাধ্যম— কোথাও কোনও সবুজ বাতাস রাখিনি আমরা ঐশী ও তার সমবয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য। ঐশীদের কাছ থেকে খেলার মাঠ কেড়ে নিয়ে আমরা উঁচু-উঁচু অট্টালিকায় ছেয়ে ফেলেছি আমাদের শহর-নগর-বন্দরগুলো। বিত্ত-প্রতিপত্তির লোভে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত জলাশয়গুলো ভরাট করেছি হরে-দরে। ঐশীদের বুক থেকে শাশ্বত মূল্যবোধগুলো কেড়ে নিয়ে ওদের পিঠে চাপিয়ে দিয়েছি বিদ্যার বোঝা। সেই বিদ্যার্জনের পথও আমরা রাজনৈতিক সংঘাত-হানাহানিতে কণ্টকিত করেছি—  হরতালে-অবরোধে-সড়কদুর্ঘটনায় করেছি মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ।
চার.
ঐশীর বাবা মাহফুজুর রহমান যে-পেশায় কাজ করতেন, সবচেয়ে বড় দায় তো সেই পুলিশ বাহিনীর ওপরই বর্তায়। মাদকাসক্তিসহ যে-উচ্ছৃক্সখল জীবন-যাপন ঐশীকে এই হীন কাজে প্রবৃত্ত করেছে, তার সঙ্গে দুর্নীতিবাজ পুলিশসদস্যদের সম্পৃক্ততা নেই? পুলিশ যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করত, মাদক যদি ঐশীর জন্য সহজলভ্য না-হত, এমন একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা হয়তো ঘটতই না। ঐশীর হস্তাক্ষরে ১২ পৃষ্ঠার একটি ‘সুইসাইড নোট’ উদ্ধার করেছে পুলিশ, যার প্রতিটি বর্ণমালাই গাঢ় অভিমান আর নীল বেদনায় সিক্ত। সেই নোট জানায়, বাবা-মাকে খুন করার আগে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মেয়েটি।
পাঁচ.
ঐশীর অধঃপতনের জন্য নিজেকেও আমি দায়ী মনে করি একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে। দেশে এখন কত-শত দৈনিক আর রেডিও-টেলিভিশন, অথচ ঐশীদের বুঝতে-পারা একজন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই বা একজন বজলুর রহমান ভাইয়াকে কোথাও দেখি না। এ দুটি মানুষ দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদের শিশুপাতা সম্পাদনার পাশাপাশি কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘর নামের দুটি শিশুসংগঠন পরিচালনা করতেন, যে-দুটি সংগঠন শিশু-কিশোরদের সৃষ্টিশীলতাকে নিরন্তর উস্কে দিত। লেখালেখির শিক্ষক একজন আফলাতুনকেও আজ আর কোথাও দেখি না। কী গভীর মমত্বেই না তিনি অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার ‘সাতভাই চম্পা’ নামের শিশুপাতাটি সম্পাদনা করতেন। তার ছোট্ট কক্ষটি ছিল নতুন লিখিয়েদের পাঠশালা। আজকের অনেক বিখ্যাত লেখকই আফলাতুনের কাছ থেকে শুদ্ধ বানানে ব্যাকরণসিদ্ধ বাক্যরচনা শিখেছেন।
আমরা বড়রা ঐশীদের জন্য  কী দায়িত্ব পালন করেছি যে, ওদের অধঃপতনে ‘ছিঃ ছিঃ’ করব? যে-দেশের শিশু-কিশোরদের দিন শুরু হয় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীর খিস্তি-খেউড়ে, রাজনৈতিক হানাহানি-খুনোখুনি যে-দেশে নিত্যঘটনা, সেই দেশে মেয়ের হাতে বাবা-মা খুন হওয়া অবিশ্বাস্য হলেও অসম্ভব কিছু নয়।
পাদটীকা
ঐশী ও তার সমবয়সীদের আমরা বুঝতে চেষ্টা করি না। ওদের পথে-পথে তৈরি করি ব্যারিকেড। ওদের হাতে তুলে দিই একটি অস্থিতিশীল দেশ। তাই ওদের কাছে সৃষ্টিশীল কিছু আশা করাও অপরাধ। সেই অপরাধে আমরা সবাই দোষী।
ঐশীর আগে আমাদের বিচার হওয়া উচিত।
সম্পাদক, দৈনিকআমাদেরসময় ।

,
Powered by Blogger.