মহানগর যুবলীগে রক্তক্ষরণ

মিল্কি হত্যা ও তারেক ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনায় রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে ঢাকা মহানগর যুবলীগে। এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় যুবলীগ পর্যন্ত।
তোলপাড় চলছে সর্বত্র। যে কোন সময় অঘটনও ঘটে যেতে পারে এ সংগঠনটিতে। এরই মধ্যে রণপ্রস্তুত মতিঝিল যুবলীগ। মুখোমুখি মিল্কি গ্রুপ ও তারেক গ্রুপ। মিল্কি গ্রুপ তাদের নেতা হত্যার জন্য তারেকের ক্যাডারদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে তারেক গ্রুপ মনে করছে মিল্কির পরিবারের লোকদের কারণেই তারেককে ক্রসয়ায়ারে নিহত হতে হয়েছে। প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত তারাও। অন্যদিকে যুবলীগে একের পর এক সন্ত্রাসীর স্থান হওয়ায় হতবাক এর সাবেক নেতারা। তারা বলছেন, বিপুল অর্থের বিনিময়ে যেসব সন্ত্রাসীকে যুবলীগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তারাই ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে দেশের এই বৃহত্তম যুব সংগঠনটিকে। ওই সব সন্ত্রাসীর কারণে যুবলীগের পরিচিতি এখন টেন্ডারলীগ, চাঁদাবাজ লীগ হিসেবে। ওইসব চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিভাবে যুবলীগের নেতা বনে গেলেন? সমপ্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা অর্থ লেনদেনের সূত্র খুঁজতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছেন লেনদেনের পরিমাণ দেখে। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা অবাক হয়ে বললেন, এত টাকা দিয়ে কি কারণে একজন লোক যুবলীগের নেতা হলেন বিষয়টি ভাবতেই পারছি না। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও। ছাত্রলীগের রাজনীতি করে আসা কেন্দ্রীয় যুবলীগের অনেকেই এখন যুবলীগ অফিসে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তারা যুবলীগ ছেড়ে দলের অন্যকোন অঙ্গসংগঠনে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যুবলীগের একজন সিনিয়র নেতা দুঃখ করে বললেন, সংগঠনে এখন গঠনতন্ত্রের কোন বালাই নেই, কমিটি প্রধানরা যখন যাকে ইচ্ছে সে পদে তার নাম ঘোষণা করে দেন।

মিল্কি, তারেক, চঞ্চল, রফিক সহ যুবলীগের সন্ত্রাসী গ্রুপের ম্যাচমেকার বলে পরিচিত যুবলীগ নেতা কাজী আনিস। বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক গোপালগঞ্জের ছেলে কাজী আনিস যুবলীগের বর্তমান কমিটি ঘোষণা হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ছিলেন ৬০০০ টাকা বেতনে যুবলীগের অফিস সহকারী। বর্তমান কমিটি ঘোষণার দিন তার নাম ওঠে যুবলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবে। অলৌকিক ভাবে তিনি এখন কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপদপ্তর সম্পাদক। মাত্র অল্প কয়েক মাসে তিনি অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে যুবলীগের চেয়ারম্যানের বাসার বিপরীত পাশে তার ২ হাজার ৮শ’ স্কয়ার ফিটের ফ্লাট। আরামদায়ক গাড়িসহ আরও প্লট ফ্লাট তো আছেই। যুবলীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, যুবলীগের কমিটিতে সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগের আগমন ঘটে আনিসের গোপন দেন-দরবারের মাধ্যমে। রাজধানীর গুলিস্তান, কাকরাইল, মতিঝিল এলাকার সন্ত্রাসী ও বখরাবাজদের নিয়ন্ত্রণ আনিসের হাতে। তার হাত দিয়েই এখানের আয়ের অর্থ যায় যুবলীগের ওপর মহলে। তার সিন্ডিকেট ছিল মতিঝিলের নিহত মিল্কি, ক্রসফায়ারে খুন তারেক ওই এলাকার সাগর, তেজগাঁওয়ের রফিক, গুলশান বাড্ডার চঞ্চল সহ তাদের সহযোগীরা। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছের লোক হওয়ায় সন্ত্রাসীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আনিস।

তেজগাঁওয়ের পরিচিত মানুষ রফিক। তিনি অধিক পরিচিত হয়ে ওঠেন প্রকাশ্য দিবালোকে সড়ক ভবনে টেন্ডার নিয়ে গুলিবর্ষণ করে। তাদের ছোড়া গুলিতে আহত হন।
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শামীম। ওই ঘটনার পরও যুবলীগে নেয়া হয় রফিককে। কমিটি ঘোষণার সময় রফিকের পদ ছিল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পরে হঠাৎ করে উপ-ত্রাণ সম্পাদক হয়ে যান তিনি। একটি সূত্রমতে বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যুবলীগের কমিটিতে তার নাম উঠেছে।
তেজগাঁও এলাকার চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে ঝুট ব্যবসা, পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সবকিছুর মালিক রফিক। একটি সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যার প্রথম বৈঠক হয় রফিকের নেতৃত্বে তেজগাঁও এলাকায় বিজি প্রেসের একটি ক্লাবে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারেক, রফিক ও চঞ্চলসহ আরও ৯ জন। এরা সবাই যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রফিকের মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতাদের ম্যানেজ করে যুবলীগ উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেয় সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। সূত্রমতে যুবলীগের ওই পদ পেতে সে ব্যয় করে ৫০ লাখ টাকা। গুলশান, বাড্ডা, মুগদা এলাকার ত্রাস সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল রফিকের স্ত্রীর ভাই বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যার কিলিং মিশনে অংশ নেয় সে। চট্টগ্রামের জোড়া খুনের আসামি বাবরকেও নেয়া হয়েছিল কমিটিতে। পরে খুনের ঘটনার পর অস্বীকার করা হয় তাকে।
ছাত্রলীগের সাবেক অনেক নেতা যারা রাজনীতিতে ত্যাগী বলে পরিচিত এমন অনেকেই বছরের পর বছর যুবলীগের কমিটিতে জায়গা পেতে ঘুরে ঘুরে পেরেশান হলেও তাদের জায়গা হয়নি কমিটিতে। অন্যদিকে সত্তরের কোটায় বয়স এমন অনেক বিত্তবান ব্যক্তি নেতা হয়েছেন যুবলীগের। রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহমেদুল কবির কোন যোগ্যতায় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছেন সে নিয়ে প্রশ্ন আছে যুবলীগের ভেতরেই। একই ভাবে প্রশ্ন আছে প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম এবং বেসিক ব্যাংকের পরিচালক আনোয়ারুল ইসলামের যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার হওয়া নিয়ে। আবার কমিটি ঘোষণার সময় আনোয়ারুল ইসলামের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল কেবল মাত্র সদস্য হিসেবে। কেন্দ্রীয় যুবলীগের আইটি সম্পাদক করা হয়েছে ফারুক নামের এক ভিওআইপি ব্যবসায়ীকে। যুবলীগের পরিচয়ে একচেটিয়া ভিওআইপি ব্যবসার মাধ্যমে অবৈধ ভাবে কয়েক শ’ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। কমিটি ঘোষণার সময় নাম প্রকাশিত হয়েছিল সহসম্পাদক হিসেবে পরে সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে গেছেন গাজীপুরের আজহারউদ্দিন। যুবলীগ অফিসে চাউর আছে দেড় কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে ওই পদটি পাওয়ার জন্য। একই ভাবে সাভারের নানা ভাবে বিতর্কিত তুহিনকে কমিটিতে আনা হয়েছে প্রশ্নযুক্ত ভাবে। উত্তরায় একটি নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িয়ে একটি মেয়েকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি এসএম জাহিদকে আনা হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত টেন্ডার শফিক নামে পরিচিত শফিককে আনা হয়েছে যুবলীগের সম্পাদকমণ্ডলীতে। মোহাম্মদপুরের ত্রাস বলে পরিচিত তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীকে স্থান দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের শ্যালক স্থান পেয়েছে যুবলীগ কমিটিতে। ওই সব সন্ত্রাসী এবং রাজনীতির গণ্ডির বাইরের বিত্তবানদের যুবলীগ কমিটিতে স্থান পাওয়া নিয়ে এখন তুমুল আলোচনা সমালোচনা চলছে যুবলীগের ভেতর। কেন্দ্রীয় যুবলীগের অনেক নেতাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, এভাবে কেনাবেচা করে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে সংগঠনের ভাবমূর্তি।
টাকা নিয়ে কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশীদ বলেন, এমন অভিযোগ আগেও উঠেছে। তবে এটা সত্য নয়। আমার জানামতে, কারও কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়নি। তিনি যুবলীগে কোন সন্ত্রাসী নেই বলেও জানান।

,
Powered by Blogger.