পাচার হয়ে ওরা অন্ধকার জগতে,তরুণীদের করুণ কাহিনী বর্ণনা

সাথী আক্তার (ছদ্মনাম)। ১৪ বছরের কিশোরী। ৬ ভাই-বোনের সবার বড়। বাবা মারা গেছেন। মা কর্মহীন। উঠতে-বসতে ভাইয়ের খোঁটা। অভুক্ত পেটে বেশি দিন সহ্য হয়নি এমন দশা। তাই দু’মুঠো ভাতের যোগাড় করতে গ্রাম ছাড়ে নীরবে।
পরিচিতজনের মাধ্যমে চলে যায় ঢাকায়। চাকরি নেয় আল মুসলিম গার্মেন্টে। কিন্তু মাস পার না হতেই শিশু বয়সের অজুহাতে চাকরি খোয়ায়। দিশাহীন সাথীর এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসে অনেকেই। কিন্তু সহানুভুতির মর্ম উদঘাটনে দেরি হয় না, যখন সাথীর কাছে ধরা পড়ে তাদের গোপন অভিলাষ। কয়েকদিন পর তার সঙ্গে পরিচয় হয় এক মহিলার। মায়ের মমতায় সাথীকে প্রলুব্ধ করতে থাকে সে । ভাল গার্মেন্টে চাকরি জুটিয়ে দেয়ার কথা বলে। নিয়ে যায় ঢাকার বাইরে। টানা তিনদিন ভ্রমণের পর সাথী বুঝতে পারে, সে আর দেশে নেই। বন্দি হয়ে পড়েছে বহুতল ভবনের একটি ফ্ল্যাটে। সর্দার-খদ্দেরদের হিন্দি-তেলুগু ভাষা শোনার পর বুঝতে পারে, হায়দরাবাদের কোন সর্দারের কাছে বিক্রি হয়েছে। এভাবে গত আড়াই বছর ধরে তার জীবনে জমা হয় অসংখ্য নির্যাতনের স্মৃতি। জীবনের এমন হাজারো করুণ স্মৃতি বয়ে গত মঙ্গলবার রাত ৮টায় দেশে ফিরে এসেছে। শুধু সাথী নয়, তার সঙ্গে আরও ৮ তরুণী ফিরে এসেছে। এছাড়া ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে আরও ৬৬ তরুণী। ওরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার হয়েছিল। মহিলা আইনজীবী সমিতির এডভোকেট সালমা আলী বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় তাদের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। দেশে ফিরে আসার পরপরই তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। গত বুধবার সন্ধ্যায় দেশে ফিরে এসে পাচার হওয়া নারীরা তাদের করুণ কাহিনী বর্ণনা করেছেন গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে। নাম-পরিচয় ও ছবি গোপন করার শর্তে তারা তাদের অন্ধকার জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরেন। কবিতা (ছদ্মনাম) বলে, তার বাড়ি পাবনা জেলায়। পিতা ছিলেন রাজমিস্ত্রি। মারা যাওয়ার পর সে সংসারের হাল ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু নিজের সৌন্দর্যের বলি হয়েছে নিজেই। ২০১১ সালে বিমাতার ফাঁদে পড়ে কলকাতায় গিয়েছিল চাকরির খোঁজে। এরপরের কাহিনী বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফুঁপিয়ে কেবল অশ্রু ঝরিয়েছে। তাকে সান্ত্বনা দিতে এসে মহিলা আইনজীবী সমিতির এক কর্মকর্তা বলেন, জীবনের অনেক গল্পই বলা যায় না। এরা বলতেও পারে না। শুধু বুঝে নিতে হয়। ১৪ বছর বয়সী রুবিনা (ছদ্মনাম) বলে, তার বাড়ি ফরিদপুর জেলার সালতা থানা এলাকায়। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে সবার বড়। পরিবারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। বাবা রাজধানীতে মাটিকাটার শ্রমিক। তার আয়ে সংসার চলে না। তাই চাকরির আশায় এক বছর আগে বাড়ি ছেড়েছিল। এরপর দালালদের মাধ্যমে কলকাতার অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায়। ফিরে আসার নানা চেষ্টা করেও পারেনি। একপর্যায়ে কলকাতার সিআইডি’র সহায়তায় উদ্ধার হয়। তারা তুলে দেয় ভারতের বেসরকারি সংস্থা ‘স্টপ ট্র্যাফিকিং অ্যান্ড অপ্রেশন অব চাইল্ড অ্যান্ড উইমেন’-এর কাছে। ভারতের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা স্বপ্না মিশ্র বলেন, পাচার হওয়া বেশ কয়েকজন তরুণীকে হায়দরাবাদ পুলিশ উদ্ধার করেছে। উদ্ধার হওয়া তরুণীদের কারও কাছেই বৈধ কাগজপত্র ছিল না। ২-৩ মাসের দীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ভারত ও বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিভিন্ন প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশের শ’ শ’ তরুণী দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে। এদের বেশির ভাগই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পতিতালয়ে বন্দি জীবন পার করছে। এর বাইরে মালয়েশিয়া, লেবানন, ওমান ও জর্ডানের বিভিন্ন এলাকায় যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেক তরুণী উদ্ধার হওয়ার পর পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু আইনি দুর্বলতার কারণে পাচারকারীরা সহজেই জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। এ কারণে ভিকটিম পরিবার এখন আর মামলা করতেও সাহস পায় না। মান-সম্মান ও আসামিদের হুমকির মুখে নীরব থাকে তারা।
 source: হ্যালো-টুডে

,
Powered by Blogger.