লিফট নিবেন, সাবধান! অপরিচিতের গাড়িতে লিফট, ঢাকায় গত তিন সপ্তাহে ১০ নারী ধর্ষিত

অপরিচিত কারো গাড়িতে লিফট নিবেন, সাবধান! প্রাণ হারাতে পারেন। ভদ্রবেশী ঠাণ্ডা মাথার একটি খুনি চক্র ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজধানীতে। তাদের টার্গেট সুন্দরী নারী। রাস্তার পাশে কিংবা বাসস্ট্যান্ডে যানবাহনের জন্য অপেক্ষারত নারীদের
লিফট দেয়ার নামে তারা গাড়িতে তুলে নেয়। এরপর টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন ও ক্রেডিট কার্ড হাতিয়ে নেয়। তারপর চক্রের সদস্যরা পালাক্রমে করে ধর্ষণ। গত তিন সপ্তাহে রাজধানীতে এ রকম ১০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দুই জন খুন হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রাইভেট কারে ঘুরে বেড়ানো এই চক্রটি আগে রাস্তায় কোন নারীকে টার্গেট করে। তারপর তার কাছে গিয়ে খুব ভদ্রভাবে জানতে চান লিফট লাগবে কিনা। চক্রটির নারী সদস্যও থাকে প্রাইভেট কারে। ওই নারীকে দেখে অনেকেই লিফট নিতে আর দ্বিধা করে না। গাড়িতে তুলে এরপর সব কিছু হাতিয়ে নিয়ে চালানো হয় পালাক্রমে ধর্ষণ। এরপর হাইওয়ের পাশে কিংবা রাজধানীর বাইরে কোন নির্জন জায়গায় ফেলে দেয়া হয় লাশ কিংবা ধর্ষিত নারীকে। সমপ্রতি এই খুনি চক্রের নির্মমতার শিকার হয়েছেন রেডিসন হোটেলের কর্মী আলেয়া ফেরদৌসী জলি (৩৪)। জলির কাছ থেকে নগদ টাকা, ডলার, ক্রেডিট কার্ড ও অন্যান্য সামগ্রী হাতিয়ে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে শেষে তাকে হত্যা করা হয়।
খুনী চক্রের সঙ্গে গাড়িতে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে জলি তার পরিচিত এক সরকারি কর্মকর্তাকে ফোন করেছিলেন। বিষয়টি খুনিরা জেনে যায়। এ কারণে ধর্ষণের পর জলিকে হত্যা করা হয়।
সম্প্রতি গ্রেফতার খুনি চক্রের সদস্য সাজু ও জহিরের সহযোগী রাজু ও তার স্ত্রী কবিতা এ সব ঘটনার বর্ণনা দেয়। গত তিন সপ্তাহে চক্রটি এ পর্যন্ত ১০ জন নারীকে ধর্ষণের এবং জলিসহ দুইজনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। এর আগে কতজন নারীকে সাজু ও জহিরের নেতৃত্বে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেনি গ্র্রেফতারকৃত স্বামী-স্ত্রী।
নিহত জলির মা রোকেয়া খাতুন জানান, প্রতিদিনের মতো গত ১৩ মে কর্মস্থল রেডিসন হোটেলে যাওয়ার উদ্দেশে দক্ষিণখানের কাওলার বাসা থেকে বের হন জলি। তখন দুপুর ১ টা। মা সুগার মিলস কর্পোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রোকেয়া খাতুন বলেন, বাসা থেকে বের হওয়ার আগে জলি বলেছিল, মা দরজা বন্ধ করো, আমি অফিসে যাচ্ছি। এটাই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। জলি হেঁটে কাওলা বাসস্ট্যান্ডে যায়।
জলির বড় ভাই রোকন উদ্দিন ও মেঝ ভাই মজিবুর রহমান জানান, জলি ওই দিন কাওলা বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এয়ারপোর্ট-গুলিস্তানগামী ৩ নম্বর বাসে চড়ে আপু অফিসে যেত। ওই দিন বিকাল ৪টায় মজিবুরের কছে রেডিসন হোটেল কর্তৃপক্ষ ফোন করে। তারা মজিবুরকে জানায়, জলি এখনো অফিসে আসেনি। মজিবুর বাসায় ফোন করে মায়ের কাছে শোনেন জলি দুপুরে বেরিয়ে গেছে। বিষয়টি তিনি হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানান। পরে হোটেল কর্তৃপক্ষ ও জলির আত্মীয়-স্বজন তার সন্ধান শুরু করে। প্রথমে খিলক্ষেত ও পরে দক্ষিণখান থানা জলির নিখোঁজের ঘটনায় জিডি গ্রহণ করেনি। পরে রেডিসন হোটেলের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে র্যাব-১ এর সহায়তা নেন জলির স্বজনরা। র্যাব-১ এর কর্মকর্তারা জলির মোবাইল ফোনের কললিস্ট অনুযায়ী তার অবস্থান নির্ণয় করে ওই এলাকায় অনুসন্ধান শুরু করেন।
র‌্যাব-১ এর হাতে গ্রেফতার রাজু ও তার স্ত্রী কবিতা জানায়, ১৩ মে দুপুর দেড়টার দিকে দূর থেকে জলিকে কাওলা বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখে তারা। সাদা রংয়ের প্রাইভেট কারের সামনে বসা ছিল সাজু ও জহির। পেছনে বসা রাজু ও কবিতা। কারের পেছনের দুই পাশে ছিল কালো গ্লাসে ঢাকা। প্রাইভেট কারটি জলির সামনে দাঁড়ায়। পেছনের গ্লাস নামিয়ে কবিতা জলিকে বলে, আপু কোথায় যাবেন ? উত্তরে জলি বলেন, রেডিসন হোটেলে যাবো। তখন কবিতা বলেন, আমরা তো ওদিকেই যাচ্ছি। চলুন আমাদের সঙ্গে। জলি ওঠে পড়ে প্রাইভেট কারে, কবিতার পাশে। এরপর গ্লাস তুলে দরজা লক করে দেয়া হয়। প্রাইভেট কারটি চলতে থাকে উত্তরার দিকে। জলির কাছে থেকে নগদ এক হাজার ডলার ও ২৩ হাজার ২শ ভারতীয় রুপি এবং নগদ সহস্রাধিক টাকা ও ক্রেডিট কার্ড ছিনিয়ে নেয় তারা। ওই দিনই জলির ক্রেডিট কার্ড দিয়ে টঙ্গী সেনা কল্যাণ সংস্থার ট্রাস্ট ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে জহির। পরের দিন খুনিরা বনানী ট্রাস্ট ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে।
এর আগে জহির, রাজু ও সাজু তিনজনে পালাক্রমে জলিকে ধর্ষণ করে। প্রাইভেট কারে ওঠানোর পর ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে একটি নম্বরে ফোন করে জলি। বিষয়টি দেখে তারা মনে করে একে বাঁচিয়ে রাখলে ধরা পড়ে যেতে হবে। তাই তারা জলিকে পূবাইলে নিয়ে গলায় গামছা, হাত পায়ে জিআই তার বেঁধে সাজু, জহির ও রাজু শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এর পর লাশ রাস্তার পাশে ফেলে ঘাতকরা কেটে পড়ে। ওই দিন রাত ৮টায় এলাকাবাসী রাস্তার পাশে একটি মহিলার লাশ দেখতে পেয়ে গাজীপুর সদর থানা পুলিশকে সংবাদ দেয়। দুই ঘণ্টা পর তার লাশ উদ্ধার করে গাজীপুর সদর হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যায় পুলিশ। পরদিন বিকালে জলির ভাই রোকনউদ্দিন ও মজিবুর রহমানসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজন গিয়ে জলির লাশ শনাক্ত করেন। সেখান থেকে লাশ আনা হয় কাওলার বাসায়। গতকাল জলিদের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে শোকাবহ পরিবেশ। গ্রেফতারকৃত রাজু ও তার স্ত্রী কবিতা স্বাভাবিকভাবে র্যাবের কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেয়। সাজু, জহির, রাজু ও তার স্ত্রী গাড়িতে নারীদের ওঠায়। তাদের ১০ জনের দলটি দীর্ঘদিন উত্তরা, গুলশান, বনানী, মিরপুর, ধানমন্ডি এলাকায় রাস্তায় গাড়ির জন্য অপেক্ষারত নারীদের বিভিন্ন পন্থায় গাড়িতে তুলে নেয়। কবিতা তিন সপ্তাহ আগে এ কাজে যোগ দেয়। কবিতা জানায়, এ তিন সপ্তাহে এভাবে ১০ জন নারীকে তারা গাড়িতে উঠিয়েছে। এদের টাকা পয়সা, স্বর্ণালংকার ও ক্রেডিট কার্ডসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে সাজু জহির ও রাজু পাশবিক নির্যাতন করেছে।
১৪ মে ক্যান্টনমেন্ট গেটের কাছে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত এক নারীকে অনুরূপ কায়দায় গাড়িতে তুলে নেয় তারা। পরে তার টাকা, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয় তারা। পরে গাজীপুর এলাকায় নিয়ে পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন করে ওই নারীকে। শ্বাসরোধে হত্যার পর ওই নারীর লাশ কাওলা এলাকায় ফেলে দেয়া হয়। এ পেশায় আসার আগে কবিতা গার্মেন্টস শ্রমিক ছিল। তার স্বামী রাজু বাস চালাক। সাজু ও জহিরের কিলার গ্রুপে যোগদান করার পর দৈনিক ৫ থেকে ১০ হাজার এবং কবিতা ৫শ থেকে এক হাজার টাকা পেতো। কিলাররা টঙ্গী এলাকায় থাকতো। রাজুর বাড়ি দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ এলাকায়। র্যাব-১ জলি হত্যাকাণ্ডে রাজু ও তার স্ত্রী কবিতাকে গ্রেফতার করে। তারা জলিসহ সব নারীর ওপর পৈশাচিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। গতকাল ভোরে র্যাবের ক্রসফায়ারে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে কিলার গ্রুপের নেতা সাজু ও জহির নিহত হয়।
 source: হ্যালো-টুডে

, ,
Powered by Blogger.