যৌবনে যার ছুটে চলার কথা সে এখন পাগলের অপবাদ নিয়ে বন্দি

নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ৪ কিঃ মিঃ দূরে, পাগল আখ্যা দিয়ে গত ৬ মাস ধরে অন্ধকার প্রকোষ্টে আটকে রাখা হয়েছে নওগাঁ সদর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের ফিরোজ নামের এক মেধাবী যুবককে। যৌবনে যার ছুটে চলার কথা সে এখন পাগলের অপবাদ নিয়ে বন্দি
জীবন কাটাচ্ছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অন্ধকার ঘরে।
৬ মাস ধরে জানালাবিহীন ঘুট-ঘুটে অন্ধকারের মধ্যে স্যাঁত স্যাঁতে ওই ঘরেই বন্দি করে রাখা হয়েছে ফিরোজকে। খাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই  চলে ওই প্রকোষ্ঠেই। বাড়ির ভিতরের উঠানের এক কোনায় গরু রাখার জায়গা সংলগ্ন ফিরোজের জন্য তৈরি ওই প্রকোষ্ঠটি। ঘরের দরজা থাকলেও সেটি তালাবদ্ধ, কোন জানালা নেই। ঘরের উত্তর দিকে নীচে মেঝে সমানে একহাত দৈর্ঘ্য প্রস্থ জায়গা, তা  লোহার রডের গ্রীল দিয়ে আটকানো। সেটিতে সারাক্ষন ঝুলানো থাকে তালা। পানির দুটি বোতল আর ভাংগা থালা তার জন্য বরাদ্দ। বিধাতার সৃষ্টি এই পৃথিবীকে এক নজর দেখবার আকুতি যেন তার চোখে মুখে ফুটে থাকে।
সৃষ্টির সেরা সামাজিক জীব মানুষ। সব মানুষই সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেই মানুষকে যদি বন্দী করে রাখা হয় অন্ধকার খাঁচায়, তার জীবনটা যে কতটা দুর্বিষহ তা সহজেই অনুমেয়। সম্পত্তির কারনে পাগল আখ্যা দিয়ে তাকে পরিকল্পিত ভাবে বন্দী করে রেখেছে তারই মা-বাবা ও ভাইয়েরা। ঘটনা প্রবাহে মনে হয় মানুষ এখনও কত অবোধ, অমানবিক এবং নির্দয় হতে পারে।
ছোট্ট সুড়ঙ্গের অপর প্রান্ত থেকে কথা হয় বন্দী ফিরোজের সাথে। সে জানায় তার বাবা-মা অকারণেই তাকে এভাবে বন্দী করে রেখেছে। কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করে এইচএসসি ক্লাশেও নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধ্যয়ন করে মেধাবী ছাত্র ফিরোজ। তাকে বিয়ে দেয় বাবা-মা। তিশা নামের ৪ বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছে তার। দাম্পত্য কলহে সংসার ভেঙে যায় ফিরোজের। ফলে স্বাভাবিক কারণেই সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ৩ ভাই ১ বোন মধ্যে ফিরোজ দ্বিতীয়। বিগত ৬ মাস ধরে তাকে আটকে রাখা হয়েছে অন্ধ কুঠিরে। ওই কুঠিরের জানালা তো দূরের কথা একমাত্র দরজাটিও খোলা হয়নি দীর্ঘ দিনেও। কোন ভাবেই আলো-বাতাস স্পর্শ করে না তাকে। ঘরের সঙ্গে লাগানো গোয়াল ঘর থাকায় গরুর মল মুত্রে দুর্গন্ধময় পরিবেশেই জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাকে। সেখানেই তার মলমূত্র ত্যাগ এবং আহার নিদ্রা। ফিরোজতো আর বন্য পশু নয়। রীতিমতো এক মানব সন্তান।
ফিরোজের বাবা আব্দুস সালাম মিয়া ও মা মরিয়ম বেগম জানান, ৮ বছর আগে ফিরোজের হঠাৎ করে মাথা ব্যথা করে।  শহরের দুলাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েও মাথা ভাল হয় না। পরে তারা ওই ডাক্তারের কথামত পাবনা পাগলাগারদে না নিয়ে পাবনা এক ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা করে। ঔষধ খেলে ভাল হয়ে যায়। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা আর চিকিৎসা ব্যবস্থা করে না। এতে সুস্থ না হওয়ার ওই ঘরটিতে পাগল বানিয়ে ফিরোজকে আটকে রাখা হয়েছে। তবে ফিরোজের সহপাঠি আর শতাধিক প্রতিবেশীরা অন্য কথা জানায়। তাদের অভিযোগ, পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতেই তার অন্য দুই ভাই কৌশলে বাবা-মাকে বুঝিয়ে বন্দি করে রেখেছে ফিরোজকে। প্রশাসন এগিয়ে এলে ফিরোজকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন তারা। ফিরোজের সাথে কথা বললে, সুস্থ মানুষের মত কথা বলে। আর ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সুন্দর ইংরেজী আর বাংলায় কথা বলে। তার বাবা মা আÍ ভাইয়েরা তাকে সুপরিকল্পিত ভাবে আটকে রেখেছে বলে জানায় সে।
তিলকপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ফিরোজ পাগল নয়। তার বাবা মা ও পরিবারের সদস্যরা তাকে পাগল বলে আখ্যা দিয়ে আসছে। উন্নত চিকিৎসা আর বাইরের আলোয় চলা ফেরা করার সুযোগ পেলে ফিরোজ সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে।
এ প্রসঙ্গে নওগাঁর সুধিজনদের সঙ্গে আলাপে বেরিয়ে আসে যে কথা, বন্দী ফিরোজের বুক ফাটা আকুতিতে যদি কোন সহৃদয় মানুষ এগিয়ে এসে তাকে মুক্ত করে বিহঙ্গের মত আলো বাতাসে চলা ফেরার সুযোগ করে দেয় তাহলেই ফিরোজ পূর্বের জীবন ফিরে পাবে।

Powered by Blogger.