উইকিলিক্সের পর এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ‘হুইসেল ব্লোয়ার’

যুক্তরাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পর ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ হিসেবে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এডওয়ার্ড স্নোডেন। তবে তিনি অ্যাসাঞ্জের মতো ভিনদেশী কেউ নন বরং তিনি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেরই নাগরিক এবং সিআইএ’র সাবেক কর্মকর্তা। সবশেষ
আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসএ’তে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন স্নোডেন। তিনি যে তথ্য ফাঁস করেছেন তাহলো ইন্টারনেটে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নজরদারী। স্নোডেন জানিয়েছেন, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ফোনকল এবং ফেসবুক, স্কাইপি, গুগল, টুইটার ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের বড় বড় ফার্মের সার্ভারের যাবতীয় তথ্য রেকর্ড করছে ওবামা প্রশাসন। যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোস্টে ফলাও করে এই তথ্য প্রচার করা হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই জন্ম নেয় নতুন এক বিতর্ক। তাহলো জঙ্গি তত্পরতায় নজরদারির নামে যুক্তরাষ্ট্র নিজ নাগরিকদেরই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার খর্ব করছে কি-না!
জঙ্গি তত্পরতা রুখতে ইন্টারনেটে গোয়েন্দা নজরদারির অতি গোপন কর্মসূচি হাতে নেয় ওয়াশিংটন, যার নাম ‘সারভেইল্যান্স প্রোগ্রাম’। এর কোড বা সাংকেতিক নাম ‘প্রিজম’ (প্ল্যানিং টুল ফর রিসোর্স ইনটিগ্রেশন, সিনক্রোনাইজেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট)। এই প্রকল্পের কাজ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সার্ভার অতিক্রমকারী জঙ্গি তথ্য সংগ্রহ করা। এটা হলো ওয়াশিংটনের সরকারি ভাষ্য। কিন্তু স্নোডেন আরো জানিয়েছেন, এই প্রোগ্রামের আওতায় বিদেশি গোয়েন্দা তত্পরতাও নজরদারি করছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রিজম শুধু সার্ভারের তথ্যই সংগ্রহ করবে না, বরং নিজ পদ্ধতিতে সংগৃহীত তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজও করবে। ঐ কর্মসূচির আওতায় মাইক্রোসফটসহ বড় বড় ইন্টারনেট ফার্মের সার্ভারে সরাসরি প্রবেশাধিকার আছে এনএসএ’র। মনিটর করা হচ্ছে আমেরিকানদের ফোনকলও। এমনটাই দাবি করা হয় গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে।
চাঞ্চল্যকর এসব অতিগোপন তথ্য ফাঁসের পর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ঐ কর্মসূচি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এনএসএ প্রধান জেনারেল কেইথ আলেকজান্ডারের ডাক পড়ে নিরাপত্তা তহবিল পরিচালনাকারী সিনেট কমিটিতে। বুধবার তিনি ঐ কমিটিকে জানান, এনএসএ জনগণের গোপনীয়তার অধিকার রক্ষায় দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই ঐ অভিযানের বিস্তারিত তথ্য তার সংস্থাতেই শ্রেণিবদ্ধ ও গচ্ছিত থাকবে। এ কর্মসূচি জঙ্গিদের অপতত্পরতা রোধে সাহায্য করছে বলেও জানান আলেকজান্ডার। ওয়াশিংটনের গোপন প্রকল্প ফাঁসের জন্য সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেনকে দায়ী করা হয়। এ ব্যাপারে অপরাধ তদন্ত শুরু হয়েছে বলেও হাউস জুডিশিয়ারি কমিটিকে নিশ্চিত করেন এফবিআই প্রধান রবার্ট মুয়েলার।
তবে গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান ২৯ বছর বয়সী স্নোডেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে জনমত যাচাইয়ে উঠে আসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারো কারো কাছে মহানায়ক স্নোডেন। ব্যক্তিগত ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটের আপিল পেইজে স্নোডেনকে জাতীয় বীর আখ্যা দেয়া হয়েছে। গত ৯ জুন ঐ পাতায় তাকে চূড়ান্ত ও পুরোপুরি ক্ষমা করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি আবেদন জানানো হয়েছে। আবেদনটি কার্যকর করতে এক মাসের মধ্যে অর্থাত্ ৯ জুলাইয়ের মধ্যে এক লাখ সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু মাত্র ছয়দিনেই অর্থাত্ শনিবার পর্যন্ত ঐ আবেদনের পক্ষে ৭৬ হাজার ৫শর বেশি স্বাক্ষর জমা পড়েছে। স্নোডেনকে বীর আখ্যা দিয়েছেন তথ্য স্বাধীনতার আত্মস্বীকৃত যোদ্ধা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তবে কারো কারো মতে স্নোডেন এক বিশ্বাসঘাতকের নাম, যিনি রাষ্ট্রীয় কর্মচারী হয়ে রাষ্ট্রের গোপন বিষয় প্রকাশ করে দিয়ে প্রতারণা করেছেন। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট রাজনীতিকরা। স্নোডেনের মতো চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগের পরিমাণ কমিয়ে আনতে এনএসএ’কে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এডওয়ার্ড স্নোডেন আসলে পালিয়ে গেছেন হংকংয়ে। সেখানকার অজানা এক স্থান থেকে তিনি জানান, ‘আমি না নায়ক, না বিশ্বাসঘাতক; আমি একজন আমেরিকান।’ সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে তার এই উক্তি ফলাও করে প্রচার করা হয়। স্নোডেন আরো জানান, খোদ আমেরিকাই সারাবিশ্বে ৬১ হাজারেরও বেশি হ্যাকিং করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের হ্যাকিংয়ের শিকার এমনই এক প্রতিষ্ঠান হংকংয়ের চাইনিজ বিশ্ববিদ্যালয় যার সার্ভার গোটা চীনে ওয়েব ট্রাফিকের কাজ করে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার পক্ষে বিশ্বের গণসমর্থন পাবারও আশা রাখেন স্নোডেন। সেই সাথে বিচারের জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর প্রক্রিয়াকে আইনের মাধ্যমে মোকাবেলারও ঘোষণা দেন তিনি।
তবে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, স্নোডেনের তথ্য ফাঁসের সাথে জড়িয়ে গেছে আরেক পরাশক্তি চীন। চীনা সার্ভারে যুক্তরাষ্ট্রের হ্যাকিংয়ের তথ্য ফাঁসের পর এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছেন বেইজিংয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও। গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটে চীনা হ্যাকাররা সাইবার হামলা করছে বলে বেশ কয়েক বছর ধরেই অভিযোগ করে আসছিলো যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি ঐসব হ্যাকাররা বেইজিং সরকারের সমর্থনপুষ্ট বলেও দোষারোপ করে ওয়াশিংটন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রই চীনে একাধিকবার সাইবার হামলা চালিয়েছে বলে জানান বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ইন্টারনেট কমিউনিকেশন্স সার্ভেইল্যান্স কর্মসূচির পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের কণ্ঠেই আছে শক্ত যুক্তি ও তীব্র আবেগ। গোয়েন্দারা বারবারই আশ্বস্ত করছেন, তারা কেউই আমেরিকানদের টেলিফোন কথোপকথন শোনেননি। বরং তাদের কর্মসূচির লক্ষ্য এমন কিছু চিহ্নিত করা যা আমেরিকার বাইরে অবস্থান করছে।

Powered by Blogger.