পঁচিশে চাকরি পেয়ে, ছাব্বিশে বিয়ে করে, ত্রিশ থেকে বাচ্চা-পালন শুরু আর ষাটে রিটায়ার করে শুধু মৃত্যুর প্রতীক্ষা?

ঠিক যেদিন রিলিজ করল 'ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি', সেই ৩১ মে সন্ধেবেলাতেই যেতে হয়েছিল শহরের অন্যতম ব্যস্ত শ্মশান নিমতলায়। সেখানে ইলেকট্রিক চুল্লির
সামনে সারি সারি শরীর সাজানো ফুল-মালা-নামাবলী আর আতর দিয়ে। ধূপের পচা গন্ধে বাতাসটা ভারি, তার সঙ্গে মিশছে রাক্ষুসে চুল্লিগুলোর ফাঁক দিয়ে আসা মড়া পোড়ানোর গন্ধ। আর একটু সময় পর এই অপেক্ষমান ঘি-মাখানো বডিগুলোরও তো ওটাই নিয়তি। একবার চুল্লিতে ঢোকানোর পর সময় লাগবে ঠিক ৪০-৪৫ মিনিট, তারপর চুল্লির দরজা খোলার পরেই ভক করে বেরিয়ে আসবে চাপ-চাপ কালো ধোঁয়া। আর তারও পরে চুল্লির নিচে নেমে দেখা যাবে প্রিয় শরীরটা জ্বলে-পুড়ে এক বড় বাটি ধোঁয়া-ওঠা খসখসে ছাই হয়ে গেছে, তাতে সাদা-কালোর চমৎকার শেড। দেখে বারবার মনে হতে থাকবে, ভুল দেখছি না তো? এত আদর-যত্ন-প্রেম-ভালবাসার এই রক্ত-মাংস-হাড় ও বিবিধ কামনা-বাসনা সাজানো শরীর শেষ অব্দি এইভাবে জাস্ট এক বাটি উত্তপ্ত ছাই?

তুলকালাম রোম্যান্সের ছবির আলোচনা কিনা এইরকম বীভৎস শ্মশানের বর্ণনাটা দিয়েই শুরু করতে হল? করতে হল, তার একনম্বর কারণ, ভরপুর যৌবনযাপনের এই ছবিটা আমি দেখলাম শ্মশানের ওই নারকীয় হ্যাং-ওভারটাকে মাথায় নিয়েই আর দু-নম্বর কারণ, এ ছবির দর্শনটাও যে আসলে এই চরম সত্যের সংলগ্ন! ছবির নায়ক বানি (রণবীর কাপুর) এমনকি নিজের মুখে কথাটা প্রায় বলেও ফেলেছে নায়িকা নয়নাকে (দীপিকা পাদুকোন): সময়কে আটকে রাখতে পারবে না, সময় এগোচ্ছে দ্রুত। পঁচিশে চাকরি পেয়ে, ছাব্বিশে বিয়ে করে, ত্রিশ থেকে বাচ্চা-পালন শুরু আর ষাটে রিটায়ার করে শুধু মৃত্যুর প্রতীক্ষা? না, ওইভাবে আর পাঁচজন আম-মানুষের ছকে জীবন কাটাতে পারবে না সে। যে কদিন বেঁচে থাকবে, সে কদিন সে লাইফটাকে এনজয় করতে চায় চুটিয়ে, চেটেপুটে খেতে চায় সমস্ত সুখ। যতটা সম্ভব, করতে চায় ফুল মস্তি। জীবনের নির্মম শেষটুকু তো সব্বারই জানা, কিন্তু তার আগে এটাও বা ভুলব কেন যে, ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি!

ঠান্ডা পানীয়ের বিঞ্জাপনে যে জেনারেশনটাকে একসময় 'জেন এক্স' বলা হতো, সেই 'জেন এক্স' বা 'জেন সেক্স'-এর চার তরুণ-তরুণীকে নিয়ে এই ছবির গল্প। দুজনের কথা তো আগেই বলেছি, বাকি দুজন হল স্বেচ্ছাচারিনী অদিতি(কল্কি কোয়েচলিন) আর ক্রিকেট-জুয়াড়ি অভি(আদিত্য রায় কাপুর)। ছবির প্রথমার্ধে এই চারজন গিয়ে পৌছচ্ছে মানালির বরফ-মোড়া পাহাড়ে, একট্রেকিং অ্যাডভেঞ্চারে। সেখানে ট্রাভেল কোম্পানির সাজানো পথ-সীমানা উল্টে ফেলে যখন বানি আর নয়না জয় করছে সাধারণের অগম্য, নানান লৌকিক-অলৌকিক ভয়ে মোড়া ভূটা শৃঙ্গ, তখনই কোথাও যেন আমরা বুঝতে পারি, আজ হোক, কাল হোক, সাধারণ জনতার সংস্কারগুলো'ককটেল'-এ (২০০১২) দীপিকাকে জাস্ট একটা বিকিনি পরে জলকেলি করতে দেখে যদি আপনার সারা শরীরে জ্বালা ধরে গিয়ে থাকে, এবং এ ছবিতেও যদি ফের আরেকবার সেই সব অনবদ্য মেয়েলি মাংসের ভাঁজ আর খাঁজ দেখবেন বলে আশা করে থাকেন, তাহলে সেই গুড়ে বালি দিয়ে বলি, এই ছবিতে দীপিকা সারাটা সময় বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা লক্ষ্মী মেয়ে। সত্যি বলতে কি, বইয়ের প্ৃথিবী পার হয়ে বাইরের পৃথিবীর মুখোমুখি হওয়াটাই এ ছবিতে তার আসল চ্যালেঞ্জ। এর পাশা-পাশি বানি এক লুচ্চে লফাঙ্গে লাস্ট বেঞ্চার, টুকে টুকে পরীক্ষা পাশ আর এন্তার মেয়ে পটানো ছাড়া যে আর কিছু জানে কিনা ভগবান জানে। একটু হেঁচকি ওঠে তাই, যখন হঠাৎ আমরা জানতে পারি, এই বানিই তলে তলে কিনা ব্যাগে নিয়ে ঘুরছে বিদেশী ইউনিভারসিটিতে মাস-কম পড়তে যাওয়ার বিরল আমন্ত্রণ, এমনকি কম্পিটিশনের সব নিয়ম মেনে সতীর্থ অভিকে তার একটু আঁচ পেতে দেয়নি। মানালির জাদু-বাস্তবীয় ভোররাতে লক্ষ্মী মেয়ে নয়না যখন তার শরীর-মনের সবটা বিচ্ছু বানিকে আরেকটু হলেই তুলে দিচ্ছিল সঘন ভালবাসায়, ঠিক তখন ওর এই কেরিয়ার-প্ল্যানের হঠাৎ প্রকাশ বাকি ছবিটার মোড় প্রায় কান ধরে ঘুরিয়ে দিল।

করণ জোহরের প্রযোজনায় 'ওয়েক আপ সিড' (২০০৯) দিয়ে পরিচালনার পৃথিবীতে পা রেখেছিলেন অয়ন মুখার্জি, আর তাঁর সেই ছবিতে আমরা দেখেছিলাম ক্লাসের ফেল-করা-আর বাপের পয়সায় ফুর্তি করা ছেলে সিদ্ধার্থকে (রণবীর কাপুর) আয়েষা ব্যানার্জির (কঙ্কনা সেনশর্মা) শাসনে-আদরে মানুষ হতে, ম্যাচিওর হতে। অয়নের দ্বিতীয় ছবি এই 'ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি'(এরও প্রযোজক করণ জোহর) ফের সেই ম্যাচিওর হবারই গল্প, তফাৎ শুধু এই যে এবার গল্পের নায়ককে পথ চলতে হয়েছে প্রায় একা। 'প্রায়' লিখলাম, কারণ, ছবির অনেক দৃশ্যেই এমন ইঙ্গিত ঠাসা যে এই টোটাল যাত্রাপথে দেশি-বিদেশি এন্তার মেয়ের সঙ্গে বিছানায় গেছে সে, তবে তাদের মধ্যে বিশেষ কেউ তাকে ম্যাচিওর বানিয়ে দিলো কিনা, সেটা আর আলাদা করে বলা নেই। ছবির শেষে তার মনে অন্তিম ও মোক্ষম মোচড়টা দেয় যে মেয়ে, আমরা শুধু সেই মেয়েটাকেই আগে থেকে চিনি, সে হলো লক্ষ্মী মেয়ে নয়না, আট বছর পরে এখন সে এক লেডি ডাক্তার। স্বভাবে-চরিত্রে সে বানির কী ভীষণ বিপরীত, আর কে জানে, এত বিপরীত বলেই হয়তো শেষটায় দুজনের এই চুম্বকীয় টান!

ছবির শুরুতেই যে আইটেম নাম্বার নাচতে মাধুরী দীক্ষিতের আবির্ভাব, সেটা মিডিয়া যতই জনপ্রিয় করার চেষ্টা করুক না কেন, মর্নিং শো-র হাউসফুল মাল্টিপ্লেক্সে একজন দর্শকও এই নাচ-গানে একটুও নড়ে-চড়ে বসলেন না। তবে সত্যি দুলুনি জাগিয়ে গেলো যে গানদুটো, সে দুটো, বুঝতেই পারছেন, হোলির গান 'বালম পিচকারি' আর পার্টির গান 'বেদতমিজ দিল'। এই গানদুটোর সুর কপি করেছেন বলে এখনও কোনও অভিযোগ ওঠেনি, তাই এর পুরো ক্রেডিটটা আপাতত প্রীতমকেই দিতে হচ্ছে। আর হ্যাঁ, গোটা ছবিটাই ভীষণ ঝকঝকে, খুব স্মার্ট, তবু কোথাও গিয়ে মনে হতে থাকে, ১৬১ মিনিটের ছবিটা আর মিনিট কুড়ি কম হলেও মন্দ হতো না।

মিডিয়ার গেলানো খবর অনুযায়ী, রণবীর আর দীপিকার প্রেম-পীরিত ভেঙে যাবার ঢের পরে নাকি এই ছবির শুটিং হয়েছে। সম্পর্ক লাটে ওঠার পরেও কিন্তু মাখো-মাখো রোম্যান্টিক সিনে দুজনেই অভিনয় করলেন চুটিয়ে, আর করবেন নাই বা কেন, না হলে আর কীসের 'জেন এক্স' এঁরা, কীসের প্রফেশনাল। শুধু এইটুকুই না। ছবির একটা দৃশ্যে দুজনে ঠোঁট ইষৎ ফাঁক করে ডুবিয়ে দিচ্ছেন দুজনের ঠোঁটে, তারপর চুষছেন জমিয়ে, ক্যামেরা সেটা ক্লোজ-আপের ধরছে হৈ-হৈ করে। এটা দেখে মনে হল, দাদা, একেই বলে বলিউড। পার্সোনাল লাইফে যাই হোক না কেন, তারপরেও পেশার প্রয়োজনে এখানে ঠিক এইভাবে জমিয়ে চোষা যায় অকাতরে। এর পাশে আমাদের টালি-পাড়াকে দেখুন। সম্পর্ক ভেঙে যাবার পরে আর কিছু বাদ দিন, বুম্বাদা-ঋতুদিকে পাশাপাশি জাস্ট একটা ছবির ফ্রেমে ধরতে পর্যন্ত মিডিয়ার ঘাম ছুটে যেতো এই সেদিন অব্দি!

দিনকয়েক আগে এই ছবির প্রোমোশনে রণবীর কাপুর এসেছিলেন কলকাতার এক ডি পি এস স্কুলে (যুগ-টুগ সব পাল্টে গেছে কিনা, তাই হিন্দি ছবির প্রোমোশন আজকাল হয় ইস্কুলে-ইস্কুলে)। এ যুগের কৃষ্ণ ঠাকুর রণবীর কাপুর সেখানে চোখের সানগ্লাস খুলে হাজারো স্কুলগার্ল-গোপিনীদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তাদের মঞ্চে উঠে নাচতে বলেন। এরপরে যা হয়, এককথায় তাকেই বোধহয় কেলেঙ্কারি বলে। হাঁচোড়-পাঁচোড় করে লক্ষ কামনার বলিউডি-নায়ককে একটু ছুঁতে গিয়ে এন্তার স্কুল-গার্ল চোট পায়, তাদের গা-হাত-পা ছড়ে-কাটে, তাদের স্কুল ড্রেস ছিঁড়ে-খুলে তারা সেযুগের গোপিনীদের মতোই বিস্রস্তবসনা হয়। এই কথাগুলো লিখলাম কচি বয়সের মেয়েদের মধ্যে রণবীরের ক্রেজটা বোঝাতে। টুকরো কলকাতাতেই এই অবস্থা হলে, বাকি গোটা দেশটার কী হাল, ভেবে দেখুন একবার! এটা জানা থাকলে এও বুঝতে পারবেন, ছবির পর ছবিতে, সেটা 'বাচনা এ হাসিনো'ই হোক, কিম্বা এই 'ইয়ে জওয়ানি', রণবীরকে অ্যাক্টো করতে হচ্ছে না বিশেষ, জাস্ট বিহেভ করলেই চলছে। 'রকেট সিং' বা 'বরফি'-র মতো কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে রণবীর এখন রোলগুলো প্রায় এইরকমই পাচ্ছেন কিনা।

আর হ্যাঁ, কিশোরী-যুবতীদের এই রণবীর-ক্রেজের খবর আর কে বেশি ভাল জানবে বলুন রণবীরের এক্স-পার্টনার দীপিকা নিজে ছাড়া? তাই তো 'কফি উইথ করণ'-এ করণ জোহরের প্রশ্নের উত্তরে দীপিকা সটান বলেই বসলেন, রণবীরকে তাঁর তরফ থেকে যোগ্য উপহার এক প্যাকেট কনডোম। জেন এক্স এখন জেন সেক্স। তার ওপর এরকম ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি। এত লাখ লাখ মেয়েকে সামলাতে আধুনিক কেষ্ট ঠাকুরের যোগ্য উপহার আর কি কিছু হতে পারে? আপনিই বলুন!

,
Powered by Blogger.