মা-মেয়ের এক স্বামী

মা ও মেয়ের একজনই স্বামী! তা-ও এই বাংলাদেশে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই খবরটি এখন আন্তর্জাতিক 
মিডিয়ায় বহুল প্রচারিত। মা’র নাম মিত্তামোনি
। তিনি এখন ৫১ বছর বয়সী। তার মেয়ে ওরোলা ডালবোট। তার বয়স ৩০ বছর। এই মা ও মেয়ের একজনই স্বামী। তার নাম নোতেন। ঘটনা বাংলাদেশের উত্তর-মধ্যমাঞ্চলের মান্দি উপজাতি গোষ্ঠীতে।
এ খবর দিয়েছে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সুপরিচিত ম্যাগাজিন ম্যারি ক্লেয়ার। এতে বলা হয়, ওরোলা ডালবোট কিছু বুঝতে শেখার আগেই তার জন্মদাতা পিতাকে হারান। তারপর তার মা মিত্তামোনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার এ স্বামীর নাম নোতেন। তার আদরেই বড় হতে থাকে ওরোলা। নোতেন দেখতে শুনতে সুশ্রী। তার মুখভরা হাসি। ওরালো যখন বড় হতে থাকেন তখন নোতেনকে দেখে ভাবতে থাকেন তার মা কত ভাগ্যবান। নোতেনের মতো সুদর্শন একজন স্বামী কল্পনা করতে থাকেন ওরালো। কিন্তু যখন তার মধ্যে বয়ঃসন্ধিক্ষণ আসে তখন অবাক হয়ে যান একটি তথ্য শুনে। তা হলো ওরালো শিশু থাকতেই তার মা যখন নোতেনকে বিয়ে করেছেন সেই একই অনুষ্ঠানে নোতেনের সঙ্গে ওরালোরও বিয়ে হয়ে গেছে। তখন ওরালোর বয়স ছিল মাত্র ৩ বছর। অর্থাৎ ওরালোও এখন নোতেনের স্ত্রী। মান্দি উপজাতির প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী এখন মা ও মেয়ে দু’জনেই নোতেনের স্ত্রী। সে অবস্থায়ই তারা ঘর-সংসার করছেন। নোতেনের সঙ্গে নিজের বিয়ের খবর জানতে পেরে ওরোলা বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি একথা শোনার পর দৌড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু এ সময় তার মা মিত্তামোনি এগিয়ে আসেন। মেয়ের পাশে দাঁড়ান। তিনি তাকে বোঝান এটা তাদের জাতির প্রথা। তাকে নোতেনকে মেনে নিতেই হবে। বাংলাদেশ ও ভারতে দুর্গম পাহাড়ি উপত্যকায় যেসব মান্দি উপজাতি বসবাস করে তাদের মধ্যে বিয়ের এমন রীতি প্রচলিত আছে। তাদের মধ্যে কোন নারী যদি বিধবা হন এবং তিনি ফের বিয়ে করতে চান তাহলে তাকে তার প্রয়াত স্বামীর কুল থেকে একজন পুরুষকে বেছে নিতে হয় স্বামী হিসেবে। কিন্তু মান্দিদের মধ্যে একা আছেন অথবা বিয়ে করেন নি এমন পুরুষ বেশির ভাগই হন যুবক। ফলে তাদেরকে যদি কোন বিধবা বিয়ে করেন তাহলে তাকে নতুন এ স্বামীর জন্য ছাড় দিতে হয়। একই সঙ্গে তার কন্যাদের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে কবুল করতে প্রস্তাব দেয়া হয়। বলা হয়, তার মেয়ে যখন পরিণত বয়সে পৌঁছবে তখন তার সঙ্গে সে দম্পতি হিসেবে দিনযাপন করবে। এমন প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলে ওই বিধবা ও তার কন্যার সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে বিয়ে হয় একজন মাত্র পুরুষের। ওরোলা ও মিত্তামোনি এমনই এক বিয়ের মাধ্যমে নোতেনের স্ত্রী। ওরোলা বলেছেন, আমার জন্মদাতা পিতা যখন মারা যান তখন মা’র বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। তিনি একাকী বাকি জীবন কাটানোর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তখন তাদের মান্দি উপজাতির প্রথা অনুযায়ী নোতেনকে প্রস্তাব করা হয় মিত্তামোনিকে বিয়ে করতে। তখন নোতেনের বয়স মাত্র ১৭ বছর। তবে বিয়েতে শর্ত দেয়া হয়, একই সঙ্গে ওরোলাকেও বিয়ে করতে হবে। সে মতে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে ওরোলা বলেন, আমি তখন এত ছোট ছিলাম যে, বিয়ের কথাটি আমার মনেই নেই। কিভাবে কি হয়েছিল আমি বলতেই পারবো না।
নোতেনের সঙ্গে মিত্তামোনি দু’সন্তানের মা হয়েছেন। তাই কখনও কখনও ওরোলা একান্তে নিজের করে একজন স্বামীর কথা চিন্তা করেন। কিন্তু তিনি তা ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন।
ওরোলার চোখে তার সঙ্গে এটা এক রকম চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত। মান্দি নারীরা সাধারণত তাদের নিজেদের পছন্দমতো পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। তাদের বিয়ের রীতি অনুযায়ী নারীরাই পরিবারের প্রধান। সমস্ত সহায় সম্পত্তির মালিক। প্রথমে যে নারী বিয়ে করবেন তিনি একটি রোমান্টিক ভাব নেন এবং তারপরেই বিয়ের প্রস্তাব করেন। এভাবে ওরোলা-ও একজন উপযুক্ত পুরুষকে বেছে নেয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু যখন তিনি জানতে পারলেন নোতেন তার সৎপিতা নন, তার স্বামী। তখন মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। মায়ের সঙ্গে মা-মেয়ের সম্পর্কে টান পড়ে। ওরোলা বলেন, তখন থেকেই মাকে আমার কাছে আর মা মনে হয় না। এখন তার কোন পরামর্শই আমি আর শুনতে চাই না। আমার মনে হচ্ছে আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। আমার জীবনকে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আমার বয়স যখন ১৫ বছর তখনই নোতেন আমাকে তার সঙ্গী হিসেবে পেতে চেষ্টা করে। তা সহ্য করতে পারছিলেন না মা। তাই একদিন জঙ্গল থেকে গাছগাছড়া এনে তা আমার খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে দেন তিনি। তাতে আমার ভীষণ বমি হয়। এই সুযোগ নিয়ে সেই রাতে নোতেনের সঙ্গে কাটিয়ে দেন মিত্তামোনি। সেই থেকে তাদের সম্পর্ক আরও খারাপ। ওরোলাও বেঁকে বসেছেন। নোতেনের স্ত্রীর অবস্থানের বিরোধিতা করে নিজের মতো করে চলা শুরু করেছেন। দিনের বেলা তিনি মধুপুর শহরে ছুটে যান। বাংলা সিনেমা দেখেন। পারিবারিক অর্থ দিয়ে স্বর্ণালঙ্কার কেনেন। ওরোলা বলেন, আমি জানি নিজের ইচ্ছামতো কোনদিন একজন পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারবো না, যে আমাকে উপহার কিনে দেবে। তাই নিজের উপহার এখন নিজেই কিনি। ওরোলা এখন তার বান্ধবীদের থেকেও নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, বান্ধবীরা শুধু ছেলেদের নিয়ে গল্প করে সময় কাটায়। তাদের সঙ্গে আমি যোগ দিতে পারি না। এই একাকিত্ব থেকে এক সময় ওরোলা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তখনই জানতে পারেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। সন্তানের মা হতে চলেছেন। এতে তার সামনে নতুন এক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। তিনি আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে আসেন। এসব শুনে তার মা মিত্তামোনির কি কোন অনুশোচনা হয়, তিনি কি নিজেকে দোষী মনে করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মিত্তামোনি বলেছেন, না। মোটেও না। আমি নিজেকে দোষী মনে করি না। ওই বিয়েটা অবশ্যই অতি জরুরি ছিল। প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার পক্ষে একা দিন কাটানো সম্ভব ছিল না। তখন নোতেন ছিল গোত্রের মধ্যে একমাত্র অবিবাহিত। মান্দিদের বিয়ের বৈধ বয়স ১৮ বছর হলেও তখনকার ১৭ বছর বয়সী নোতেনকেই তার স্বামী হিসেবে বেছে নিতে হয়েছিল। এর কোন বিকল্প তার সামনে ছিল না। তাই একই সঙ্গে ওরোলাকে বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল নোতেনকে। ফলে ওরোলা যখন বড় হতে থাকে তখন তার প্রতি নোতেনের আকর্ষণ বাড়তে থাকে। আমি তখন একপেশে হয়ে পড়ি। এ বিষয়টি আমার কাছে ছিল ভীষণ বেদনার। ওরোলা ও মিত্তামোনির মতো মান্দি সমাজে অনেক মা-মেয়ে আছেন যারা একই স্বামীর ঘর-সংসার করেন। তাদের মধ্যে পারভিন রেমা (৩৬) একজন। তিনি যখন ১৩ বছর বয়সী তখন তার বিধবা মায়ের সঙ্গে ১৮ বছর বয়সী এক যুবককে স্বামী হিসেবে বিয়ে করেন। রেমা বলেন, এটা আমাকে মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু আমার ভিতরে ছিল অন্য কথা। আমার মনে হচ্ছিল বিয়ের পর আমার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন আমার মায়ের বয়স ছিল ৩৬ বছর। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন তিনি এত কমবয়সী একজনকে ্‌িবয়ে করলেন। এরপর আস্তে আস্তে আমি পরিবারের কর্তৃত্ব নিতে থাকি। স্বামীর কাছ থেকে মাকে আলাদা করে দিতে কৌশল নিই। প্রথম তিন বছর তার সাহচর্য পেয়েছিলেন মা। তারপর আমি এমন কৌশল নিই যাতে আমাদের স্বামী তার প্রতি আকর্ষণ হারায়। আমি তার জন্য মজাদার খাবার রান্না করতে থাকি। যখনই আমাকে কাছে চায় তখন কোন সময়ের জন্য তাকে না বলি না। এর দু’এক বছর পরে রেমা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখা হয় নিতা। নিতার বয়স এখন ১৪ বছর। পারভিন রেমা বলেন, যখনই এখন নিতার দিকে তাকাই তখনই আমার অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। আমি ভাবি মা আমাকে কিভাবে জোর করে বিয়ে দিয়ে আমাকে শেষ করে দিয়েছেন। তখন আমার খুব রাগ হয়। মন খারাপ হয়ে যায়। মার মতো একই কাজ কি আমি আমার মেয়ের জন্য করবো? রেমা বলেন- না। কারণ, নিতার জীবন সম্পর্কে অনেক পছন্দ থাকতে পারে। আশায় তার বুক ভরা। আমি নিতাকে কলেজে পাঠাতে চাই যাতে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কাকে সে বিয়ে করবে। নিতা এখন স্কুলে পড়ে। তার পরিবারের অস্বাভাবিক সম্পর্কের কারণে সহপাঠীরা তাকে তিরস্কার করে। আচিক বিচিক সংস্থার প্রধান বয়সী নারী সুলেখা ম্রোং বলেন, যুবতীদের জন্য এ প্রথা ভীষণ রকম অবিচার। তাদেরকে কোন পছন্দ দেয়া হয় না। মায়ের সঙ্গে মেয়ের স্বামী ভাগ করে নেয়ার ঘটনায় তাদের মধ্যে মানসিক এক যাতনা হয়। এ জন্য সামপ্রতিক সময়ে এমন বিয়ে এড়াতে অনেক যুবতী এলাকা থেকে পালিয়ে ঢাকা চলে এসেছেন। তারা কেউ পরিচারিকা না হয় বিউটিশিয়ান।   সামপ্রতিক সময়ে অনেক পর্যবেক্ষক দেখতে পেয়েছেন মা-মেয়ের এমন বিয়ের রীতি অনেকটা কমে এসেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, এ উপজাতির ২৫ হাজার বাংলাদেশীর শতকরা ৯০ ভাগকে ক্যাথলিক মিশনারিগুলো ধর্মান্তরিত করাতে পেরেছে।

,
Powered by Blogger.