শত আকুতিতেও মন গলেনি পুলিশের

মারপিট। চড়-থাপ্পড়, লাথি। এরপর বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি। ঘটনাটি ৩৪ দিন আগের। কক্সবাজার শহরে 
জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষের সময় হতভাগ্য যুবক নবাব উদ্দিন সন্দেহের বশে পুলিশের এমন নির্মমতার শিকার হন। তার শত আকুতিতেও মন গলেনি পুলিশের। ওইদিনের ঘটনার ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের পর তোলপাড় চলে দেশজুড়ে। এ চিত্র প্রচারের পর বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে পুলিশ। ঘটনার পর প্রচার হয় যুবক নবাব মিয়া মারা গেছেন। তার লাশ গুম করা হয়েছে। তবে ঘটনার ৩৩
দিন পর তাকে খোঁজে বের করে পুলিশ জানিয়েছে, তিনি মারা যাননি। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। পুলিশ নবাব মিয়াকে খুঁজে পেলেও ওই দিনের গুলির ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যকে খুঁজে পায়নি। তার অনুসন্ধান করছে তারা। এমনটিই জানিয়েছে জেলা পুলিশ। তবে ঘটনার ভিডিও ক্লিপে আহত ব্যক্তির চেয়ে স্পষ্টই দেখা গেছে ওই পুলিশ সদস্যসহ অন্যদের।
এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আকতারকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নবাব মিয়াকে গুলি করার পেছনে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল কি না এবং ভিডিও ক্লিপটি কে বা কারা ফেসবুকের মাধ্যমে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে তাও তদন্ত করে দেখা হবে। এ ঘটনায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার আইনে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়াও চলছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. আজাদ মিয়া। জানা যায়, উদ্ধার হওয়া নবাব মিয়া (৩০) কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ডিকপাড়ার সিরাজুল হকের ছেলে। ৩০ বছর বয়সী নবাব মিয়া পেশায় কৃষক ও এক কন্যাসন্তানের জনক। পুলিশের ভয়ে ও আতঙ্কে তিনি দীর্ঘ প্রায় ১ মাস ধরে গোপনে চট্টগ্রামের ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসার পর কিছুটা সূস্থ হলে ৪-৫ দিন আগে বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। এদিকে ফেসবুকে ভিডিও ক্লিপ প্রচারের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ইমেজ সঙ্কটে পড়া পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল নড়েচড়ে বসেছে। ওই দিনের ঘটনার সময় নবাব মিয়ার কি অপরাধ ছিল, নবাব মিয়াকে নাগালে পেয়েও আটক না করে কেন মারধর করা হয়েছে, মারধরের সঙ্গে সঙ্গে কি এমন পরিস্থিতিতে তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হলো, আর কে বা কারা পুলিশের এ ঘটনা খুব কাছ থেকে ভিডিওচিত্র ধারণ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে পুলিশের ইমেজ ক্ষুণ্ন করলো, পুলিশের কোন সদস্য নবাব মিয়াকে গুলি করেছে, ভিডিওচিত্র ধারণ করেছে কে, কি উদ্দেশে ভিডিও ক্লিপ প্রচার করা হয়েছে- এমন বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু করেছে পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি তৎপর গোয়েন্দা সংস্থাও। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে ভিডিও ক্লিপটি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে কি না তাও তদন্ত হচ্ছে। জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে দেশে সর্বপ্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে কক্সবাজারে। গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরে সাঈদীর মুক্তির দাবিতে জামায়াতের কর্মসূিচ পালনের সময় জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও শতাধিক। ওই ঘটনায় ৩ জনের মৃত্যু হলেও জামায়াতে ইসলামী ৪ জনের মৃত্যু এবং বেশ কয়েকটি লাশ গুম হয়েছে উল্লেখ করে সারা দেশে একদিন ও কক্সবাজারে টানা ৩ দিন হরতাল পালন করে। সেই থেকে ওই ঘটনায় একাধিক লাশ গুম হয়েছে বলে ব্যাপক প্রচার পায় কক্সবাজারে। ঘটনার কয়েক দিন পর ফেসবুকে ছড়ানো একটি ভিডিও ক্লিপ লাশ গুম গুজবের পালে নতুন করে হাওয়া দেয়। কিন্তু কিছুতেই মিলছিল না ওই যুবকের পরিচয়। ফলে তার খোঁজও পাওয়া যায়নি। ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, এক যুবককে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য একটি খালি কক্ষে কিল-ঘুষি-লাথি মারতে থাকে। এর মধ্যেই আরেক পুলিশ সদস্য তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে চলে যায়। এর পর ছটফট করতে থাকে ওই যুবক। ভিডিও ক্লিপটি ফেসবুকে প্রচার পাওয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয় দেশে-বিদেশে। উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও বিভিন্ন দেশ। ওই ভিডিও চিত্রের কারণে দেশে-বিদেশে ইমেজ সঙ্কটে পড়ে বাংলাদেশ পুলিশ। কিন্তু গুলিবিদ্ধ ওই যুবকের পরিচয়, তার লাশ কোথায়, জীবিত থাকলে সে কোথায় আছে- এসব বিষয়ে অন্ধকারে ছিল সাধারণ মানুষ। অন্ধকারে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। কিন্তু ভিডিও ক্লিপ প্রচার পাওয়ার পর খোদ পুলিশ বাহিনীতেই এ ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। পুলিশ ওই ঘটনাটি উদ্ঘাটনে ব্যাপক তদন্ত কার্যক্রম চালায়। অবশেষে বুধবার সন্ধ্যায় ওই যুবককে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন পুলিশ। নবাব মিয়া নামের ওই যুবককে পুলিশ উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় নিয়ে আসে। সঙ্গে তার মা জহুরা খাতুনসহ বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয় ছিলেন। ছিলেন পিএমখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল্লাহ ও ইউপি সদস্য তাজমহল। সেখানে কথা হয় নবাব মিয়ার সঙ্গে। নবাব মিয়া জানান, তিনি একজন সাধারণ কৃষক। ১৪ই ফেব্রুয়ারি বৃহসপতিবার তিনি কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ায় খালার বাসায় বেড়াতে আসেন। শুক্রবারে জুমার নামাজ আদায় করেন রুমালিয়ারছড়া ভিটিআই সংলগ্ন মসজিদে। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পড়ে যান দু’দিক থেকে আসা দু’টি মিছিলের মাঝখানে। তখন পুলিশ ধাওয়া দিলে শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। এসময় তিনি দৌড়ে পিটি স্কুল বাজারের কাছে একটি স্থানে আশ্রয় নেন। কিছুক্ষণ পরেই কয়েকজন পুলিশ গিয়ে তাকে গালিগালাজ করতে করতে কিল-ঘুষি-লাথি মারতে থাকেন। এ সময় তিনি  চিৎকার করে তাদের কাছে ঘটনায় জড়িত নয় বলে বাঁচার আকুতি জানান। হঠাৎ করেই একজন পুলিশ তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে ফেলে চলে যায়। এর পর তার আর কিছুই স্মরণে ছিল না। পরে কে বা কারা তাকে উদ্ধার করে আল ফুয়াদ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে জরুরি চিকিৎসার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামের ন্যাশনাল হাসপাতালে। ২৮ দিন চিকিৎসার পর ৪-৫ দিন আগে সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। তবে ভয়ে ও আতঙ্কে ঘর থেকেই বের হননি। তিনি জানান, পুলিশ তাকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করেছে। আবার তাকে পুলিশ আমাকে মেরে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। কক্সবাজার সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ জসীম উদ্দিন জানান, নবাব মিয়ার অবস্থা মারা যাওয়ার মতো গুরুতর ছিল না। একটি মহল পরিকল্পিতভাবে সে মারা গিয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছে। তাকে জীবিত উদ্ধার করার ফলে গুজবের অবসান হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া কোন পুলিশ সদস্য তাকে গুলি করেছে এবং পুলিশের কেউ ভিডিওচিত্র ধারণ করে প্রচার করেছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

 source:mzamin

Powered by Blogger.