পায়ে মাথা ঠুকে মাফ চেয়েছিল আঁখি, এসিড মেরে তার রূপ

পায়ে মাথা ঠুকে মাফ চেয়েছিল আঁখি। কিন্তু ক্ষমা করিনি। তার বদলে এসিড ঢেলে দিয়েছি মাথায়। সারা জীবনের জন্য দাসী বানাতে চেয়েছিলাম। ইডেন কলেজ ছাত্রী শারমিন আখতার আঁখির ওপর এসিড সন্ত্রাসের এমন বর্ণনা দিয়েছে মনির। গতকাল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মনির বলে, দীর্ঘদিন প্রেম করেছে আঁখি। মালিবাগের কাজী অফিসে বিয়ে করে সংসার
করেছে। কয়েক মাস পর হঠাৎ মন ঘুরে যায় তার। এক পর্যায়ে বাসা থেকে পালিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। এর প্রতিশোধ নিতেই এসিড মেরে তার রূপ পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, মেয়েটিকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করতেই এসিড মেরেছে মনির। তার দাবি, মেয়েটি তার সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রেম করেছে। বিয়ে করে সংসারও করেছে। ৬-৭ মাস আগে বনিবনা না হওয়ায় তালাক দিয়েছে। এতে ক্ষিপ্ত হয়েই তার ওপর এসিড ঢেলে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, মনিরের দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তদন্ত সূত্র জানায়, গত ১৫ই জানুয়ারি রাজধানীর চাঁনখারপুল এলাকায় ইডেন কলেজের ছাত্রী আঁখির ওপর এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। থানা-পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম বিষয়টির ছায়া তদন্ত শুরু করে। গত ২১শে জানুয়ারি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে যে, এ ঘটনার মূল আসামি মো. মনির উদ্দিন (২৭)। তার পিতার নাম আবু তাহের (মৃত)। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার বড়িশ্বর গ্রামে। সে লুকিয়ে আছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা ও বরকল উপজেলার মধ্যবর্তী কোন এক দুর্গম এলাকায় জনৈক আমলকি বিক্রেতার বাড়িতে। পরে এডিসি মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমানের নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশের দু’টি দল ওই এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ২২শে জানুয়ারি চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের আমলকি ব্যবসায়ী আফতাবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, বরকল এলাকার কুরকুটিছড়ি গ্রাম থেকে রংগু চৌধুরী বিক্রির জন্য আমলকি পাঠায়, কিন্তু সে তার বাড়ি চেনে না। তার বাড়ি চিনতে পারে রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার ঘাটের জনৈক বক্কর সরদার। তার সহযোগিতা চাইলে সে জানায়, তার বাড়ির সঠিক ঠিকানা জানতে পারবে রনি ও আতিক নামের দুই ব্যক্তি। রনির কাছে সহযোগিতা চাইলে সে বলে, আমি তার বাড়ি চিনি এবং আপনাদের সহযোগিতা করবো। টিমটি স্পিডবোট নিয়ে কুরকুটিছড়ির দিকে রওনা হয়। আর খাগড়াছড়ির টিমটি একই উদ্দেশে ট্রলার নিয়ে লংগদু থেকে রওনা দেয়। ওইদিন বিকাল সাড়ে চারটার দিকে কুরকুটিছড়ি গ্রামে গোয়েন্দা পুলিশের দু’টি টিম ও বরকল থানার পুলিশের একটি টিম একত্রিত হয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আসামি মনির টিলার পিছনে পাহাড়ে ঢুকে পড়ে। গোয়েন্দা পুলিশ ও স্থানীয় থানা পুলিশ গভীর রাত পর্যন্ত পাহাড়ি বনের ভিতরে আসামিকে খুঁজতে থাকে। সারারাত অভিযান চালিয়েও তাকে খুঁজে পায়নি তারা। পরের দিন সকালে স্থানীয় লোকজনের সহায়তা নিয়ে পাহাড়ি জঙ্গলে দিনভর অভিযান চালানো হয়। রাতের বেলায়ও গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল ও স্থানীয় থানা পুলিশ আসামি যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য রাতভর লেকের চারপাশে ট্রলার নিয়ে টহল অব্যাহত রাখে। এছাড়াও শুভলং ক্যাম্প, রাঙ্গামাটি সদর, লংগদু ও মাইনীমুখে স্থানীয় থানা পুলিশের সহায়তায় চেক পোস্ট বসানো হয়। রাতেই গোয়েন্দা পুলিশের দলটি নিশ্চিত হয় যে, আসামি পাহাড়ের ভিতরে লুকিয়ে আছে। এক পর্যায়ে ২৪শে জানুয়ারি স্থানীয় জনগণকে আসামি ধরিয়ে দেয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ১০ হাজারে টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলে তাদের সবাই অভিযানে অংশগ্রহণ করে। তাদের একটি দল ১০-১৫টি ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে লেকের ভিতরে আসামীকে খোঁজ করতে থাকে। আসামির আশ্রয়দাতা রঙ্গু চৌধুরী ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে কৌশলে সহযোগিতা নেয়া হয়। পরে দু’দিনের অভিযান শেষে পাহাড়ের একটি গুহা থেকে আসামি মনিরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় গোয়েন্দা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে তার অপরাধের কথা স্বীকার করে। জানায়, আঁখির সঙ্গে তার ২-৩ বছরের পরিচয়, প্রেম ও বিয়ে হয়। ৬-৭ মাস আগে তাদের ডিভোর্স হয়। পরে আসামি জরুরি কথা আছে বলে তাকে ডেকে কাজি অফিসে নিয়ে যায় ও আবার বিয়ে করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ১৫ই জানুয়ারি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীর চাঁনখারপুলের কাজী অফিসের বাথরুমে নিয়ে এসিড মেরে ঝলসে দেয়। পরে ছুরিকাঘাত করে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ইন্সপেক্টর তপন চন্দ্র সাহা বলেন, গ্রেপ্তারের পর মনিরকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করা হয়। পরে আদালত ৯ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। গতকাল রিমান্ডের প্রথম দিনে মনির আরও জানায়, আঁখিকে রাস্তা থেকে তুলে কাজী অফিসের বাথরুমে নিয়েছিলাম। সেখানে ছুরি ও এসিড দেখিয়ে ফের বিয়ে করতে বলেছিলাম। কিন্তু আমার কথা মেনে নেয়নি। আঁখি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার ওপর এসিড সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও ইডেন কলেজের ছাত্রীরা আন্দোলন করছে।

Powered by Blogger.