নিশিকন্যাদের বিচিত্র জীবন (অনুসন্ধানী)

  সবুজের নাকের ডগা পেরিয়ে লিপটনের হাত ধরে আদালত চত্বর থেকে বেরিয়ে সোজা রিকশায় ওঠে লিপি। পিছু ডাকছে সবুজ, অনেকবার। শুধু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা সাপটা বলে দেয় লিপি- তোমার চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিয়েছে লিপটন। এখন আমি লিপটনের। তোমার টাকা শোধ হয়ে গেছে। তুমি আর আমাকে ডাকবা না। ডিস্টার্ব করলে ভাল হবে
না। রিকশার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে থাকে সবুজ। ওই ঘটনা ঢাকা জজকোর্ট চত্বরের। সবুজের কাছ থেকে জানা গেল, লিপি একজন নিশিকন্যা, কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় তার নিয়ন্ত্রণে রাতের যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতো। তার আয়ের টাকার ভাগ নিতো সবুজ। কেন তার আয়ের টাকার ভাগ নিতো? সবুজের জবাব, সে ছয় মাস আগে ২ হাজার টাকা ধার দিয়ে লিপিকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। কথা ছিল পুলিশে ধরলে থানায় নেয়া বা কোর্টে চালান দেয়ার আগে তাকে ছাড়িয়ে নিতে হবে। কিন্তু এবার পুলিশে ধরলে তাকে থানা থেকে ছাড়াতে পারেনি। পুলিশ অনেক টাকা চেয়েছিল। সবুজের আগেই তার এলাকার লিপটন কোর্টে এসে দ্রুত ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে তাকে। হয়তো লিপটন আরও কিছু বেশি টাকা ধার দিয়েছে। এখন লিপির আয়ের ভাগ খাবে সে। কথাগুলো বলতে বলতে হেঁটে চলে যায় সবুজ।
সন্ধ্যা হয় হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনের আম গাছতলায় তুমুল ঝগড়া চলছে। দুই নিশিকন্যা বনাম এক পুরুষ। দুই নিশি কন্যা একযোগে চেঁচিয়ে বলছে, তোমার মতো মালিকের দরকার নাই, পুলিশকে টাকা দেবো, গায়েও বেত খাবো, তা হলে গতর খাটানো টাকা তোমাকে দেবো কেন? মানিকের আন্ডারে যারা আছে তাদের তো পুলিশে তাড়ায় না, পুলিশে মারে না। পরিষ্কার কথা এখন থেকে- টাকা হয় পুলিশকে দেবো না হয় তোমাকে দেবো, দুই দিক টাকা দিতে পারবো না, নইলে আমরা মানিকের কাছে চলে যাবো, তোমার টাকা তুমি নিয়ে যাও। ওই উক্তিগুলো ঢাকা শহরের নিশিকন্যা ও তাদের মালিকদের।
ঢাকা শহরের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা সেতু থেকে শুরু করে উত্তরা পর্যন্ত এলাকায় বিচরণ বহু সংখ্যক নিশিকন্যার। এদের সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। ঢাকা শহরের ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থার হিসাব অনুসারে রাজধানীতে আছে দুই থেকে আড়াই হাজার নিশিকন্যা। কেবলমাত্র রাতের বেলাতেই এরা কাজে নামে বলে এদের পরিচিতি নিশিকন্যা হিসেবে।  যৌনকর্মীদের সংগঠন সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক ইন অব বাংলাদেশের সভানেত্রী আলেয়া বেগম জানালেন, তাদের পরিসংখ্যান অনুসারে রাজধানী শহরে নিশিকন্যাদের সংখ্যা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার। তার মতে ওই সংখ্যা সব সময় ঠিক থাকে না, বেশি মাত্রায় পুলিশি যন্ত্রণা হলে ওরা ব্যবসা ছেড়ে চলে যায়। সে সময় নিশিকন্যাদের সংখ্যা কমে যায়। আবার পরিবেশ অনুকূলে থাকলে সংখ্যা বাড়ে।
দিনের বেলায় এরা ঘুমায় বিভিন্ন পার্ক কিংবা ফুটপাতে। বিকাল থেকে শুরু হয় এদের সাজগোজ। পার্ক বা ফুটপাতে বসে ছোট্ট একখানা আয়না সামনে মেলে ধরে পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়ে, কড়া লাল রঙের লিপিস্টক ঠোঁটে মেখে কখনও দলবেঁধে, কখনও একা একা রাস্তার মোড়ে দাঁড়ায় খদ্দেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। কেবল ব্যস্ততম সড়কগুলোর মোড়ে মোড়েই নয় খদ্দের ধরতে অনেক সময় এদের দেখা যায় নিরিবিলি ওভারব্রিজগুলোর ওপর।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানী শহরের প্রেস ক্লাব এলাকা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে, হাইকোর্টের দক্ষিণ পাশের রাস্তা, গুলিস্তান এলাকা, কাকরাইল মোড় এলাকা, রাজমণি সিনেমা হল এলাকা, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর মাজার রোড, কাকলী এলাকা, বিমানবন্দর এলাকা, মহাখালী মোড় এলাকা, বুড়িগঙ্গা সেতু, ওসমানী উদ্যান, রমনা পার্ক, সরওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, শ্যামলী ওভারব্রিজ, ধানমন্ডি লেক পাড়, কুড়িল বিশ্বরোড, শাহবাগ এলাকা সহ ঢাকার আরও কিছু এলাকায় অবাধ বিচরণ নিশিকন্যাদের।
ওই সব নিশিকন্যা, তাদের নিয়ন্ত্রণকারী মাস্তান পুলিশের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে নিশিকন্যাদের ক্রীতদাসী হওয়ার কাহিনী। প্রতিটি এলাকাতেই নিশিকন্যাদের নিয়ন্ত্রণ ওই এলাকার মাস্তান যুবকদের হাতে। তাদের আয়ের ভাগ দিতে হয় ওই সব মাস্তান যুবকদেরকে। তাদেরকে ভাগ না দিলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়, কখনও কখনও মার খেয়ে পঙ্গু হতে হয়। সূত্র মতে আবার একই এলাকায় আছে মাস্তান যুবকদের একাধিক গ্রুপ। তাদের মধ্যে নিশিকন্যারা বেচা বিক্রি হয়। ওরা পুঁজি বিনিয়োগ করে।

বেশি টাকা দিয়ে একজনের নিয়ন্ত্রণে থাকা নিশিকন্যাকে কিনে নেয় আরেক জন। নিশিকন্যাদের হাত বদল হওয়ার সবচেয়ে বড় জায়গা হচ্ছে আদালত চত্বর। কোন সময় কোন নিশিকন্যাকে পুলিশে ধরে আদালতে সোপর্দ করলে সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনে তাদের মালিকরা। আদালতে কাজ করে এমন একজন পুলিশ এই প্রতিবেদককে বলেন, নিশিকন্যারা আদালতে আসার পর তাদের জামিন করাতে দ্রুত আদালতে চলে আসে তাদের মালিকরা। তারাই মুহুরী আইনজীবী ঠিক করে জামিনে ছাড়িয়ে নেয়, আদালত জরিমানা করলে তারাই জরিমানার টাকা শোধ করে দেয়। এখানে দেখা যায় কোন কারণে গ্রেপ্তার হওয়া নিশিকন্যার মালিক সঠিক সময়ে আদালতে পৌঁছতে না পারলে ওই এলাকার বা অন্য এলাকার কোন মালিক তাকে জামিন করিয়ে তার জিম্মায় নিয়ে যায়। প্রয়োজন হলে আগের মালিকের কাছ থেকে নেয়া টাকা শোধ করে দেয় নতুন মালিক। ওই পুলিশ সূত্র জানায়, বিভিন্ন এলাকার নিশিকন্যাদের নিয়ন্ত্রণকারী মালিকদের এজেন্ট আছে আদালত চত্বরে, এদের বেশির ভাগ মুহুরী। কোন মেয়েকে আদালতে আনা হলে ওই সব এজেন্ট ফোন করে জানিয়ে দেয় তার লোককে। দ্রুত এসে তারা জামিন করিয়ে নিশিকন্যাকে নিয়ে নেয় তাদের জিম্মায়।
সরজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রেস ক্লাব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ও হাইকোর্ট এলাকার নিশিকন্যাদের নিয়ন্ত্রণ করে মানিক ও বিল্লাল নামের দুই যুবক। কমলাপুর রেল স্টেশন এলাকার নিশিকন্যাদের নিয়ন্ত্রণ লিপটন, সবুজ, সালু ও গেটু সালামের হাতে। ফার্মগেট এলাকার নিয়ন্ত্রণ নুর সালামের হাতে, কাকরাইল মোড় ও রাজমনি সিনেমা হল এলাকার নিশিকন্যাদের আয়ের ভাগ নেয় কাবুল, সোনা। রমনা পার্ক এলাকায় নিশাত, নিয়ন, কালা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকার শিপন, নতুন, বিমল সহ ৮ জন। চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকায় আসাদ, বিজু সহ আরও ৯ জন। মিরপুর মাজার রোডে নিশিকন্যাদের নিয়ন্ত্রণ মহিলাদের হাতে। পুরনো নিশিকন্যারা ভাগ নেয় নতুন নিশিকন্যাদের যৌন কর্মের আয়ের টাকার।
ভোলার সালমা প্রায় এক বছর ধরে রাজধানীতে ক্রীতদাসী নিশিকন্যা হিসেবে কাজ করছে কাকরাইল এলাকায়। তার সঙ্গে কথা হয় কাকরাইল মোড়ে এসএ পরিবহনের সামনে দাঁড়িয়ে। সালমা জানান, এক বছরে তিন বার হাত বদল হয়েছে তার। প্রথমে ঢাকায় আসার পর দেড় হাজার টাকা দিয়ে একজন কিনে নিয়েছিল তাকে, তার আয়ের প্রায় পুরোটাই নিয়ে নিতো ওই যুবক। মাঝে মধ্যে অত্যাচারও করতো। সালমা গোপনে ওই এলাকারই আরেক মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার কাছে চলে যায়। ওই মালিক তাকে দেয় পাঁচ হাজার টাকা। সালমা তৃতীয়বার মালিক বদল করে গত মাসে। সাত হাজার টাকা নিয়ে এবার জায়গা বদল করে চলে এসেছে ওসমানী উদ্যান এলাকায়।
দুঃখের সঙ্গে সালমা বলেন, নিজের খতর খাটিয়ে খাবো তারও উপায় নেই, সেখানেও বিক্রি হয়ে যেতে হবে, ভাগ দিতে হবে আয়ের টাকার। এমনই জীবন, এমনই ভাগ্য!

Powered by Blogger.