ঈদ ঘিরে সক্রিয় অপরাধীরা, উৎকণ্ঠায় নাগরিক

আসন্ন ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অজ্ঞান-মলম পার্টির কার্যক্রমসহ সব ধরনের অপরাধ নতুন মাত্রা পেয়েছে।

উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এসব অপরাধ। এতে নিরাপত্তাহীনতায়
আতঙ্কিত নাগরিকরা। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দাবি, এসব বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইন প্রয়োগকারী বাহিনী।

রাজধানীর ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরের শপিংমলগুলোর বাড়তি নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। আর ঘরমুখো যাত্রীদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং জোরদার করা হয়েছে। গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও বিভিন্ন জায়গায় কাজে লাগানো হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে শুধুমাত্র রাজধানীতে খুন হয়েছে অন্তত ২৫ জন। এর মধ্যে শেষ তিন দিনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা এবং ব্যবসায়িসহ অন্তত ৯ জন খুন হয়েছেন।

এছাড়া ডিএমপির রেকর্ড অনুযায়ী জুলাই মাসে অপহরণ ১৩টি, ছিনতাই ১৪টি, ডাকাতি ৬ টি, আবাসিক ভবন-যানবাহনসহ সর্বমোট ৩৮০টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। আরো অনেক অপরাধ ঘটেছে যেগুলোর কোনো মামলা না হওয়ায় ডিএমপির রেকর্ডভুক্ত হয়নি।

আর এসব অপরাধের কারণে রমযান মাসে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। তবে এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবেই মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তারা।

এসব অপরাধ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম আরটিএনএন- কে বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী ও মলম পার্টির সদস্যরা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটাতে সক্রিয় থাকে। এদের ধরতে ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান, শপিংমল ও ক্রাইম জোনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ফাঁদ পেতে সক্রিয় রয়েছে।

ডিএমপির মিডিয়া ও গণসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ঈদ উপলক্ষে রাজধানীতে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩১ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর থানাধীন কাউলা এলাকায় র্যা বের হেফাজতে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ খুন হন ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক মিল্কি হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি একই শাখার যুগ্ম সম্পাদক এইচএম জাহিদ সিদ্দিক তারেক ও শাহ আলম।

এর আগের দিন নগরীর বিভিন্ন স্থানে ৫টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গুলশানে মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের  সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন খান মিল্কীকে এলোপাথাড়ি গুলি করে হত্যা করা হয়। একইদিন বিকেল ৫টার দিকে পুরান ঢাকার নলগোলা শাহ আব্দুল হামিদ কালান্দার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মো. নওশাদ হোসেন (৩৫) নামের এক ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী নিহত হন।

এছাড়া সন্ধ্যায় কদমতলী থানার পূর্ব জুরাইনে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে আবু সালেহ (৪০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। অন্যদিকে সকালে রাজধানীর রমনা পার্কের লেকে ভাসমান অবস্থায় এক অজ্ঞাতনামা কিশোরের লাশ পাওয়া যায়। এর আগে ২৯ জুলাই রাত ৮টার দিকে হাজারীবাগ বাজারে ব্যবসায়ী জসীম উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তিনি ২২ নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। একই রাতে ঢাকা-মাওয়া সড়কের ঝিলমিল প্রকল্পের কাছে ছিনতাই করে পালানোর সময় র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই ছিনতাইকারী নিহত হন।

মলম পার্টির দৌরাত্ম্য
রাজধানীতে অজ্ঞান ও মলম পার্টির দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে। ঢাকার এই পরিচিত অপরাধ পরিবহনে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের আষ্টেপিষ্টে মারছে। তবে এদের কয়েকটি গ্রুপকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এরা মূলত বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ঘাটসহ বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাসে কখনো হকার, কখনো ক্যানভাসার সেজে সাধারণ যাত্রীদের চেতনানাশক ওষুধ মিশ্রিত খাবার খাইয়ে অচেতন করার পর সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়।

গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, রাজধানীসহ এর আশপাশ এলাকায় বেশ কয়েকটি অজ্ঞান পার্টি সিন্ডিকেট রয়েছে। যার মধ্যে ডন, হাজী লিটন ও লিংকন গ্রুপ বেশি সক্রিয়।

অজ্ঞান ও মলম পার্টি প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম জানান, ঈদকে কেন্দ্র করে বরাবরই অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেড়ে যায়। এছাড়া র্যা ব-পুলিশ পরিচয় দিয়ে রাস্তা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে অন্যত্র ফেলে রেখে যায়। এসব প্রতারকদের ঠেকাতে রোযার শুরু থেকেই মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা।

তিনি বলেন, এ গ্রুপের কয়েকজন সদস্য যাত্রী বেসে গাড়ির ভেতরে টার্গেটকৃত যাত্রীর পাশে বসে। আলাপ চারিতার এক পর্যায়ে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে এবং সঙ্গে থাক চেতনানাশক ওষুধ মিশ্রিত খাবার খাওয়ায়। কিছুক্ষণ পরে ওই যাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়লে সব কিছু লুট করে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়। অনেক সময় এরা আবার বিভিন্ন ধরনের ফুড আইটেম নিয়ে গাড়িতে উঠে ক্যানভাচার সেজে লেকচার দিয়ে নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রি করে বলেও জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

চাঁদাবাজি, জাল টাকা ও কার্ড জালিয়াতি
ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীসহ সারা দেশে বেড়ে গেছে চাঁদাবাজির ঘটনা। ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, গত মে মাসে চাঁদাবাজির ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ২৫টি। জুনে ৪৫টি ও জুলাইয়ে এখন পর্যন্ত ২৫টি মামলা হয়েছে।

এছাড়া ঈদ উপলক্ষে রাজধানীতে টাকা জালকারী চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। জাল টাকা জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড জালিয়াতি চক্র।

গত ২৩ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল রাজধানীর উত্তরা, গুলশান এবং মতিঝিল এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন সময় ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত মো. সেলিম (৪২), আরিফ হোসেন খান (৩৮), মঞ্জুরুল হক (৩০) এবং আসাদুল ইসলাম (৩০) নামের চার প্রকৌশলীকে গ্রেপ্তার করে। এরা প্রত্যেকে এটিএম বুথ প্রতারণাকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত।

ডিএমপি গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম  বলেন, ‘রাজধানীতে নীরব চাঁদাবাজি হচ্ছে না, তা নয়। ভিকটিমরা অনেক সময় নিরাপত্তার ভয়ে পুলিশকে না জানিয়ে গোপনে চাঁদা দিচ্ছেন।’

টাকা জাল চক্র সম্পর্কে তিনি বলেন, মূলত দুই ঈদকে সামনে রেখেই জাল টাকার চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবার রাজধানীতে জালনোটের ব্যাপকতা তেমন না হলেও কিছু কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে জালনোট পাওয়া যাচ্ছে। তবে সব ধরনের অপরাধের বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সতর্ক রয়েছে বলে জানান মনিরুল ইসলাম।

এদিকে, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের হটলাইন চালু করা হয়েছে। কেউ কোনো অপরাধের শিকার হলে এসব হটলাইনে সরাসরি যোগাযোগ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ডিএমপি থেকে।

ডিএমপির হটলাইন: ০১৭১৩৩৯৮৩২৬-৯, ০১১৯১০০১১০০, ০১১৯১০০১১১১।
-আরটিএনএন

,
Powered by Blogger.