ঐশীর প্রেমের বলি বাবা-মা

মেয়ে ঐশী’র প্রেমের বলি হয়েছেন পুলিশ দম্পতি মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান। নিজের পিতা-মাতাকে চেতনানাশক দ্রব্য খাইয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে সে। ঐশীর জবানিতেই বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য। মাহফুজ-স্বপ্নার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ঐশী নিখোঁজ ছিল। গতকাল   দুপুরে সে পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে। জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে।
গতকাল রাতে  গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করা হয়।  হত্যার নেপথ্যে পিতা-মাতার সঙ্গে মেয়ের দ্বন্দ্বের তথ্য খুঁজে পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ঐশীর প্রেমের সম্পর্ক, ইয়াবা সেবন ও উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে। এ বিরোধ থেকেই সে বাবা-মাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তবে ওই হত্যাকাণ্ডে ঐশী একাই অংশ নেয় নাকি আরও কেউ সঙ্গে ছিল সে সম্পর্কে গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেননি গোয়েন্দারা। ঘটনার নেপথ্য কাহিনী বের করতে ঐশী, তার প্রেমিক রনি, বান্ধবী তৃষা ও বাসার কাজের মেয়ে সুমিকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পল্টন থানায় নিহত পুলিশ দম্পতির কন্যা ঐশী রহমান আত্মসমর্পণ করে। পরে গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম তাকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এরা হচ্ছে ঐশীর প্রেমিক রনি, বান্ধবী তৃষা ও পুলিশ দম্পতির বাসার কাজের মেয়ে সুমি। ঢাকা মহানগর পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে পুলিশ দম্পতি হত্যাকাণ্ডে ঐশী’র সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। হত্যাকাণ্ডের সময় নিহত দম্পতি ছাড়া ওই বাসায় ঐশী, তার ছোট ভাই ঐহি রহমান ও কাজের মেয়ে সুমি ছিল। এর বাইরে আরও কেউ ছিল কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আটককৃতদের বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ জানতে পারলেও তদন্তের স্বার্থে তা বলা যাচ্ছে না। মনিরুল ইসলাম বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরপরই থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি পুলিশ তদন্ত শুরু করে। এ ঘটনায় কয়েকজন সন্দেহভাজন আসামিকে আটক করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই নিহত দম্পতির মেয়ে ঐশী রহমান ও কাজের মেয়ে সুমি বেগম নিখোঁজ ছিল। তাদের আটক করার পাশাপাশি  নিহত দম্পতির ছোট ছেলে ঐহি রহমানকে পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে। এই তিনজনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে হত্যাকাণ্ডে ঐশীর সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া, এ ঘটনায়  জড়িত সন্দেহে ঐশীর ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার নাম রনি ওরফে জনি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)’র পরিদর্শক (রাজনৈতিক) মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের একমাত্র মেয়ে ঐশী (১৭) ছিল বেপরোয়া প্রকৃতির। বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করতো। তাদের সঙ্গে নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতো। ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ও লেভেল’ পড়ুয়া ঐশীর আচরণে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব ছিল। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ছেলেদের নিয়ে বাসায় আসতো। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় তার আচরণ ছিল খিটখিটে। এসব বিষয় নিয়ে মায়ের সঙ্গে প্রায়ই তার দ্বন্দ্ব ও ঝগড়া বাধতো। পিতা পুলিশের পরিদর্শক হওয়ায় বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতেন। ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর নিতে পারতেন না। কিন্তু মেয়ের এমন আচরণের তথ্য পাওয়ার পর তিনি মেয়ের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এ নিয়ে পিতা-মাতা উভয়ের সঙ্গে ঐশী ও তার কথিত বন্ধুদের দূরত্ব তৈরি হয়। এক পর্যায়ে বুধবার গভীর রাতে রাজধানীর চামেলীবাগের নিজ বাসায় ঐশী তার পিতা-মাতাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। ময়না তদন্তসূত্রে জানা যায়, মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রীকে বেডরুমের খাটের ওপর ধারালো অস্ত্র- ছুরি ও বঁটি দিয়ে কোপানো হয়েছে। গলা, বুক ও পাঁজরসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আঘাত করে হত্যা করা হয়। পরে দু’জনের লাশ কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে টেনেহিঁচড়ে মেয়ের রুমের বাথরুমে ফেলে রাখে।  মাহফুজের শরীরে দু’টি বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। স্বপ্নার শরীরে ছিল ১১টি আঘাতের দাগ। এ  থেকে পুলিশ ধারণা করছে- পিতার তুলনায় মাতার প্রতি ঐশীর বেশি ক্ষোভ থাকতে পারে।  বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড শাহীন বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে ঐশী তার ছোট ভাই ঐহি (৯) ও বাসার কাজের মেয়েকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসময় ওই বাড়ির ম্যানেজার আমজাদ হোসেন পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া তাদের বাইরে যেতে বাধা দেন। একই সঙ্গে মাহফুজুর রহমানের স্ত্রী স্বপ্না রহমানের মোবাইল ফোনে কল করেন তিনি। তখন ওই মোবাইল ফোন থেকে বলা হয়, ‘আমি রাজশাহী আছি। ওদের যেতে দাও।’ তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মায়ের  মোবাইল ফোন তখন ঐশীর কাছেই ছিল। মায়ের ফোন বাজতে থাকলে সে কৌশলে গেট থেকে সরে গিয়ে আমজাদের কল রিসিভ করে। মায়ের কণ্ঠ নকল করে মেয়েদের বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ম্যানেজার আমজাদ হোসেন বলেন, গত ৪ঠা আগস্ট বাড়ি ভাড়া নেয়ার জন্য ঐশীদের বাসায় যাই। তখন পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেছিলেন, আমার মেয়ে নিয়ে সমস্যায় আছি। যখন-তখন ওকে বাইরে বের হতে দিও না। তারপরও যেতে চাইলে ওর মাকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিও।

পুলিশ হেফাজতে যারা: খুনের রহস্য উদঘাটনের জন্য আরও যাদের পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে তারা হচ্ছে ঐশীর বান্ধবী তৃষা, সিএনজি চালক, নিহত দম্পতির ছোট ছেলে ঐহি, খালু রবিউল আলম, সিকিউরিটি গার্ড শাহীন, মোতালেব ও আমজাদ।
ঐহিকে বিভিন্ন কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পিতা-মাতার খুনের রাতে সে কোথায় ছিল। কি দেখেছে। তার বড় বোন কোথায় নিয়ে গিয়েছিল। পিতা-মাতার সঙ্গে তাদের কেমন সম্পর্ক ছিল। এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এছাড়া, খুন হওয়ার রাত তিনটার দিকে স্বপ্না রহমানের মোবাইল ফোন থেকে ঐশীর খালুর নম্বরে কে ফোন করেছিল সে বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে। লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তারা বলেছিলেন, পিতা-মাতা হত্যাকাণ্ডের পর ঐশী মায়ের মোবাইল ফোন দিয়ে তার খালুর সঙ্গে কথা বলেছিল। পিতা-মাতার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার কথা খালুকে জানিয়েছিল। মোবাইল ফোন প্রযুক্তির সহায়তায় ওই ফোনের অবস্থান ছিল তখন গেণ্ডারিয়া এলাকায়। পরে তারা পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকার একটি বাসায় ছিল। গোয়েন্দারা জানান, খুনের পরদিন ঐশী ছোট ভাই ও কাজের মেয়ে নিয়ে একটি সিএনজি ভাড়া করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছে। বিভিন্নজনের কাছে ফোন করেছে আশ্রয় পাওয়ার জন্য। কাউকে ফোনে না পেয়ে সিএনজি চালকের সঙ্গে তার মুগদার বাসায় গিয়েছে। ওই চালককে বলেছে, তার পরিচিত বন্ধুকে খুঁজে পাচ্ছে না। তাই কাজের মেয়েকে একদিনের জন্য তার কাছে রাখতে অনুরোধ করে। এতে সিএনজি চালক রাজি হয়ে ওই কাজের মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দেয়। পরে ঐশী সেখান থেকে কাকরাইল গিয়ে তার ছোট ভাইকে আরেকটি সিএনজি ভাড়া করে চামেলীবাগের বাসায় পাঠিয়ে দেয়। ঐশী চলে যায় তার বান্ধবী তৃষার বাসায়। তাকে আটকের পাশাপাশি তার কাছ থেকে দু’টি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। ব্যাগ থেকে বাসার বেশ কিছু স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার হয়েছে। পিতা-মাতার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকলেও বয়সের বিবেচনায় ঐশীকে এই হত্যা মামলার রাজসাক্ষী করা হতে পারে। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। সকল আসামি গ্রেপ্তারের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঐশীর কথা অসংলগ্ন। মাঝে মধ্যে সে উলটাপালটা বলছে। ফলে তার সব কথা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। কিভাবে বাবা-মাকে হত্যা করেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ঐশী বলেছে, রাত সোয়া ১১টার দিকে তার বাবা অফিস থেকে ফেরার পর সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে। এরপর বাবা কফি খেতে চাইলে সে নিজেই বানানোর কথা বলে। আগে থেকে কিনে আনা চেতনানাশক ওষুধ কফির সঙ্গে মিশিয়ে বাবা-মাকে খেতে দেয়। কফি খাওয়ার পরই তারা দু’জনই বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তখন গৃহকর্মী ও ছোট ভাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এরপর সে বাসায় থাকা বঁটি ও চাকু দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে বাবা-মাকে হত্যা করে। তদন্তকারী ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বাবা-মাকে হত্যার আগে সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে ইয়াবা খেয়েছে বলে স্বীকার করে ঐশী। ওই আড্ডায় রনিও ছিল। ইয়াবা খাওয়ার কারণে লাশ সরাতে তার কোন সমস্যা হয়নি। তবে ঐশীর এই বক্তব্য বিশ্বাস হচ্ছে না গোয়েন্দাদের। সে কি কারও সাজানো বক্তব্য দিচ্ছে না নিজেই বলছে তা এখনই পরিষ্কার হওয়া যায়নি। তবে বখাটে রনির সঙ্গেই ঐশীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ইয়াবা খাওয়া ও বখাটের সঙ্গে প্রেম কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি ঐশীর বাবা-মা। তাই মাঝে মধ্যেই ঐশীকে মারধর করতেন তার মা স্বপ্না রহমান।
নিহত মাহফুজুর রহমানের পিতার নাম মরহুম মতিউর রহমান ওরফে মতিন মাস্টার। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মাহফুজ ছিলেন সবার বড়। গতকাল বাদ সন্ধ্যা ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানার মরাগাঙ্গকান্দা গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে পুলিশ দম্পতির লাশ দাফন করা হয়। এর আগে বিকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন জামে মসজিদে নিহত দম্পতির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।-mzamin

Powered by Blogger.