আগুন ধরিয়ে দেবে আজ এ মেয়ে!

অলির ঠিক সামনে এসে থামল স্টোন ব্ল্যাক ফিয়াট গাড়িটা। আমার খুব চেনা এই গাড়ি, গোল্ডেন নম্বর প্লেটের ধারালো হরফ, বনেটের ওপর এরিয়ালের শৈলি, কাঠুরিয়া শিল্প নৈপুণ্যে সাজানো ড্যাশবোর্ড… সেই কবে থেকে অন্তরমহলে ঢুকে পড়েছে এসবের জলছবি। এ গাড়ির ব্যাকসিটের আদর-বিলাসের
ভৌগোলিক ঠিকানা বা, জমিনদারির জরিপ যেমন আমার নখদর্পণে, এই গাড়ির মালকিনের হৃদয়পুরের আশমানদারীও আমার সুবিদিত। এই যেমন, আজ ঠিক রঞ্জাবতীর মনখারাপ। সেটা আমি ওর এই গাড়ি দেখেই মালুম করলাম। মানে! মানে, উড়ুক মেয়ে রঞ্জাবতীর মনের আকাশে মেঘ জমলে, সেদিন ও এই কালো গাড়িটায় চড়ে আমার সঙ্গে কলকাতার পথে বেরোয়। এ শহরের নিশিঠেকে যায়!
ফুরিয়ে আসা সিগ্রেট-টায় সুখটান দিয়ে এগিয়ে গেলাম দুলালির কাছে। ওকে নামিয়ে বুড়ো মহাদেব গাড়ি নিয়ে চলে গেল পার্ক সার্কাসের দিকে। অর্থাৎ রঞ্জাবতীর আজও রাত হবে ফিরতে। ফিরবে হয়ত সেই ভোর রাত্তিরে, হয়ত আমার সঙ্গেই, আমার ছোট্ট ডেরায়। কোনওকিছুতেই এ মেয়ের ছুঁৎ-মার্গ নেই যেন! এই ক’ বছরে একদিনের জন্যেও ওর মধ্যে নেকিপনাও দেখিনি। এক সম্পর্ক থেকে আর এক সম্পর্কে যেতে যেতে ও এভাবেই আমাকে বলে যায় ওর নিত্য নতুন সম্পর্কের অধুরা-অধ্যায়ের কথা। ইচ্ছে হলে, মহাদেবকে ছেড়ে দেয়। শনিবার এলে রঞ্জা এমনই করে।
এগিয়ে হাতটা ধরলাম ওর। চোখের দিকে ক্ষণিকের জন্য তাকাল রঞ্জাবতী। তারপর হাতটা সরিয়ে নিল। বুঝলাম, অভিমানের দোসর আমিও। কোমরের ভয়াল বাঁকে সাহসী হাত রেখে কাছে টানতেই ওমা! দিব্যি ঘন হয়ে বুকের কাছে সরে এল মেয়ে। হাতটা ধরে মৃদু চাপ দিলাম। নরম, পাখির পালকের মত নরম, পেলব ফর্সা হাত। মধ্যমার নীলাটায় মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে মুঠো বন্ধ হাতটা ধরে অপলক চেয়ে রইলাম ওর চোখের দিকে। রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ছিল। কিছু বলতে যেতেই, ও আমার ঠোঁটের ওপর নিঃশব্দের তর্জনী রাখল। তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে চোখের দিকে। ক্লান্তি ঢাকার অছিলায় লাইনারে মাখামাখি ওর স্মোকি আইজ। অহর্নিশি যা আমাকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়। কী গহন ওর এই চাহনিবিলাস। নির্ঘাত দহন জেনেও আমি শ্যামা পোকার মতো এগিয়ে যাই। রঞ্জাবতী আমাকে পুড়িয়ে ছারখার করে ওর দাউদাউ আগুনে। সত্যি কথা কী, অমন আগুনে পুড়তে হৃদকমলে ধুম লাগে আমারও!
রাসেল স্ট্রিটের নিওনের তেরচা আলোকরেখা এসে পড়েছে ওর মুখে। সেই আলোয় ওর পিচরঙ ঠোঁট দুটো চিকচিক করছে। অনেকটা সোহার মতো ওর ঠোঁট। লিপলাইনারের বাঁক-উপবাঁকে মিশে গেছে ঠোঁটের প্রান্তরেখার সারল্য। রঞ্জা হাসলে, ওর গালে খুব সুন্দর ছোট্ট একটা টোল পড়ে। কানের দু’ পাশে নেমে এসেছে দু’ গাছি চুল। ঠিক প্রেমেন মিত্তিরের কবিতার মতো, ‘তোমার স্বপন দেখি/ সে স্বপনে তুমি কতটুকু/ একগুছি চুল,/ কানের দুলের পাশে/ নেমেছে শিথিল হয়ে/ মেদুর মেঘের রাত থেকে’।
আজ কি একটু বেশিই সুন্দরী দেখাচ্ছে রঞ্জাবতীকে? আজ ও ফেডেড জিন্সের ওপর সাদা শর্ট শার্ট পড়েছে। ওপরের যে দুটো বাটন খোলা, সেখানটায় যেন পাহাড়িয়া নিঃসঙ্গতায় বৌদ্ধিক মন্ত্রের চির মুগ্ধতা। শহরের রাতকুঠুরিতে আগুন ধরিয়ে দেবে আজ এ মেয়ে!
ওকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম অলির মধ্যে। অলি। আমার বহু স্মৃতি আর গহন সুখের ঠিকানা অলিপাব। কলেজবেলার বন্ধুনিদের হাত ধরে এ শহরের এই নিশিঠেকে পা বাড়িয়েছিলাম। তারপর কত শত বার। অলি এখনও একরকম। পিতলের পানপাত্রে সেই আগের মতোই চলকানো কোহলের পরিবেশন, দেওয়ালে ঝিম ধরা আলোর মায়া দীপন, টেবিলে টেবিলে কথাচারিতার স্মৃতি গন্ধে চারপাশ ভুরভুর, অলি নস্টালজিক!
(ক্রমশ)
-আবীর মুখোপাধ্যায়
নিশিঠেক-১

,
Powered by Blogger.