অস্থিরতায় ভুগছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ

অস্থিরতায় ভুগছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। নানা কারণে এ অস্থিরতা। একদিকে ক্ষমতায় যাওয়ার মোহ। অন্যদিকে ঘরে-বাইরে চাপ। ‘কুল রাখি না শ্যাম রাখি’ অবস্থায় একেক সময় একেক কথা বলছেন এরশাদ। আর এসব কারণেই তার ঘুম আসে না- এমন মন্তব্য দলীয়
ঘনিষ্ট সুত্রের। দলীয় নেতা-কর্মীদের সন্তুষ্ট রাখতে বারবার একক নির্বাচনের ঘোষণা দিচ্ছেন। বিরোধীদলীয় জোটকে খুশি করতে বলছেন- দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। বড় কোন দল নির্বাচনে না গেলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। আগামী নির্বাচনে সরকারের ভরাডুবি হবে। সামনের নির্বাচনে সরকার ১০০ আসনও পাবে না। আবার বলছেন, সরকারের জনপ্রিয়তা ১০ ভাগও নেই। অপরদিকে জেলে যাওয়ার ভয়ে এরশাদ মেনে চলছেন সরকারের প্রেসক্রিপশন। বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতির জন্য কলঙ্কতিলক। এ ব্যবস্থা জাতীয় পার্টি সমর্থন করে না। জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী দল। যে কোন পরিস্থিতিতে জাপা নির্বাচনে যাবে। পার্টির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, এরশাদের অস্থিরতার কারণ আন্তর্জাতিক মহল বিশেষের পরামর্শ। ওইসব মহলের যারা এরশাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন তারা আগামী নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী প্রার্থী দাঁড় করানোর পরামর্শ দিয়েছেন তাকে।
জাতীয় পার্টির একাধিক সূত্র জানায়, এরশাদ যখনই সরকারের সমালোচনায় মুখর হন তখনই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আসে নানা চাপ। তখন কিছুদিন বন্ধ রাখেন সমালোচনা। চাপমুক্ত হতে তিনি একেক সময় গ্রহণ করেন একেক কৌশল। গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এরশাদ সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন একনাগাড়ে। ১২ই জানুয়ারি নীলফামারীর এক সমাবেশে এরশাদ বলেন, শিগগিরই আমরা মহাজোট থেকে বেরিয়ে আসবো। ৮ই নভেম্বর সিলেট সার্কিট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সময় হলেই মহাজোট থেকে বেরিয়ে এসে একক নির্বাচন করবো। ৪ঠা নভেম্বর টাঙ্গাইলে এক নির্বাচনী জনসভায় বলেন, বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে মানুষ হতাশ। ৪ বছরে দেশে কোন উন্নয়ন হয়নি। ঘরে থাকলে খুন আর বাইরে থাকলে গুমের ঘটনা ঘটছে। মানুষ এ অবস্থার পরিবর্তন চায়। ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার ওয়াদা করে সরকার ক্ষমতায় এলেও চাকরি হচ্ছে টাকা ও মন্ত্রীদের সুপারিশে। ধারাবাহিকভাবে এরশাদের এসব বক্তব্যের পাশাপশি চাঙ্গা হতে থাকে আদালতে ঝুলে থাকা তার মামলাগুলো। ১০ই জানুয়ারি আদালতে মঞ্জুর হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। ওই মামলার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮শে ফেব্রুয়ারি। আগামী ৭ই ফেব্রুয়ারি তাকে রাডার ক্রয় দুর্নীতি মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে হবে। এ দু’টি মামলার মধ্যে মঞ্জুর হত্যা মামলা নিয়ে এরশাদ বেশ বিচলিত বলে জানা গেছে।
জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা জানান, পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের মাধ্যমে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সম্প্রতি এরশাদকে বলা হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনে বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোট অংশ না নিলেও জাতীয় পার্টিকে অংশ নিতে হবে। অন্যথায় তাকে জেলে যেতে হবে। এ হুমকির পর সরকারের মন জয় করতে এরশাদ গ্রহণ করেছেন নতুন কৌশল। নির্বাচনের প্রায় ১ বছর বাকি থাকতেই তিনি আগামী নির্বাচনের প্রার্থী ঘোষণা শুরু করেছেন। অথচ কয়েক দিন আগেও এরশাদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আগামীতে ওয়ান ইলেভেনের মতো সরকার আসতে পারে বলেও আশঙ্কা করেছেন। নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই এরশাদ ৯৩ জন প্রার্থীর মনোনয়ন ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ২৮শে জানুয়ারি ৩২ জন এবং ২৯শে জানুয়ারি ৬১ জনের নাম ঘোষণা করেন। তবে কৌশলগত কারণে এরশাদ রংপুর বিভাগ থেকে কারও নাম ঘোষণা করেননি। ৯৩ জনের নাম ঘোষণার পর এরশাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। শিগগিরই অন্য প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত করা হবে।
জাতীয় পার্টির একজন প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, প্রার্থীদের নাম ঘোষণার মাধ্যমে এরশাদ সরকারকে এ বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, বিরোধী দলের কেউ নির্বাচনে আসুক আর না আসুক জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। সরকারের কাছ থেকে চাপমুক্ত থাকার কৌশল হিসেবেই কেবল এরশাদ এত আগে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করছেন। পার্টির এক সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য বিষয়টিকে অর্থহীন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে এরশাদ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দেয়ার মতো নেতারা এখন এরশাদের কাছে ভিড়তে পারছেন না। তারা এরশাদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে অবস্থান করছেন। এরশাদ কেবল ২ জন প্রেসিডিয়াম সদস্যের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। যারা পরামর্শ দিচ্ছেন তারা রাজনৈতিকভাবে খুবই অদূরদর্শী। এ কারণেই এরশাদ একেক সময় একেক কথা বলছেন। এতে একদিকে যেমন দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি ইমেজ ক্ষুণœ হচ্ছে এরশাদের।
অপর এক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করবে না। যে কোন একটি জোটে থেকেই নির্বাচন করবে। কারণ, পার্টির মূল লক্ষ্য যে কোন মূল্যে ক্ষমতার মধ্যে থাকা। এ ক্ষেত্রে ১৮ দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নির্বাচন করার সম্ভাবনা বেশি। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে না গেলে জাতীয় পার্টি তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেবে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনে যাবে জাপা। তখন সংসদে প্রধান বিরোধীদলের নেতা হতেও এরশাদের আপত্তি থাকবে না। পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকলে জাপা নির্বাচনে না-ও যেতে পারে। এখন এরশাদ যেসব সিদ্ধান্ত বা বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন তা কেবলই চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে। সম্ভাব্য নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দিচ্ছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, দলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী অনেক আগে থেকেই মহাজোট ছাড়তে এরশাদকে চাপ দিয়ে আসছেন। পার্টির চেয়ারম্যানের মুখপাত্র প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি নির্বাচন হবে। কারণ, নির্বাচন না হলে দেশে অনির্বাচিত সরকার আসবে। এমন সরকার কারও কাম্য হতে পারে না। তিনি বলেন, বড় দু’টি দলের প্রার্থীরা সব সময় মাঠে থাকেন। আমরা তুলনামূলকভাবে ছোট দল। আমাদের প্রার্থীরা সব সময় মাঠে থাকেন না। তাই আগে নাম ঘোষণা করে আমরা প্রার্থীদের মাঠে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছি। কোন মনোনীত প্রার্থীর পারফরমেন্স ভাল না হলে নির্বাচনের আগে তিনি বাদও পড়তে পারেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের সংগঠন দুর্বল। সংগঠনকে শক্তিশালী করতেই প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যেসব আসনে এখনও প্রার্থীদের নাম মনোনয়ন করা হয়নি সেসব আসনে শিগগিরই মনোনয়ন দেয়া হবে। তবে এরশাদ আমেরিকা থেকে ফেরার আগে নতুন করে আর কোন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে না। একই ধরনের তথ্য জানিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় জানান, ৫ই ফেব্রুয়ারি এরশাদ আমেরিকা যাচ্ছেন। ৭ই ফেব্রুয়ারি তিনি আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ‘আমেরিকান ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্ট’-এ অংশ নেবেন। সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বৈঠক করবেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তবে দেশে ফিরতে আরও ৩-৪ দিন বেশি সময় লাগতে পারে। দলীয় চেয়ারম্যান দেশে ফেরার পর জাতীয় পার্টি নাটকীয় কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

Powered by Blogger.