প্রেম এখন অগ্নিকুণ্ডলী, প্রেম প্রতারক ভয়ঙ্কর পুলিশ

প্রেমের আগুনে পুড়ে হলাম ছাই।’ চায়নার জীবনে প্রেম এখন অগ্নিকুণ্ডলী। আর তাই এখন গুনগুনিয়ে চায়না গান ধরে ‘প্রেমের আগুনে…’। ভালবাসার মানুষ তার সঙ্গে করেছে প্রতারণা। দিয়েছে ধোঁকা। এ জ্বালায় এখন জ্বলছে
চায়না। স্বপ্ন নিয়ে প্রেমিক মানুষকে করেছিল স্বামী। আর এ স্বামী নামের প্রাণপুরুষ যখন তার সঙ্গে করে ছলনা, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কি হতে পারে। দীর্ঘ ভালবাসার পর যাকে বিয়ে করেছিল চায়না, সেই স্বামীই তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আর এ স্বামী পুলিশের একজন এএসআই। নাম শেখ জাহিদুর রহমান জাহিদ (৩৫)। অথচ মিথ্যা পরিচয়ে হিন্দু সেজে তাকে সিঁদুর পরিয়েছিল। যখন চায়না জানতে পারে সে হিন্দু নয়, তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে- তখনই তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন। পুরো নাম চায়না মহলদার টিনা। খুলনা বটিয়াঘাটা থানার ছয়ঘরিয়া গ্রামের হরিদাস মহলদারের কন্যা। বয়স মাত্র কুড়ি। এলাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার ফলতিতা এলাকায় মাসীর বাড়ি বেড়াতে যায় সে। সেখানে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে চায়না রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করে। সংগীতে মুগ্ধ হয় অনুষ্ঠানে নিরাপত্তায় দায়িত্বরত ফকিরহাট থানার এএসআই শেখ জাহিদুর রহমান জাহিদ। তার নজরে পড়ে চায়না। চায়নার কাছে নিজেকে পরিচয় দেয়, সে হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তার নাম সঞ্জয় কুমার বিশ্বাস। চায়নার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তার মুঠোফোনের নম্বর সংগ্রহ করে জাহিদ। মোবাইলে চায়নার সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রথমে পাত্তা না দিলেও এক পর্যায়ে সঞ্জয় বিশ্বাস পরিচয় দেয়া জাহিদের অমায়িক আচরণ ও কথাবার্তায় মুগ্ধ হয় চায়না। বিয়ের আশ্বাসে সরল বিশ্বাসে জাহিদের প্রেমে সাড়া দেয় সে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সুন্দর জীবনের। কিন্তু তখনও সে বুঝতে পারেনি কি অন্ধকার সময় তার জীবনে অপেক্ষা করছে। গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে চায়না গোপালগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যায়। জাহিদও সেখানে হাজির। বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণে গোপালগঞ্জ খাদেমবাড়ি গণেশ পাগলার মন্দিরে প্রেমিকা চায়নার সিঁথিতে পরিয়ে দেয় সিঁদুর। সঞ্জয়রূপী জাহিদ সেদিন বলেছিল ‘সবাইকে জানিয়ে তোমাকে ঘরে তুলে নেবো।’ চায়না জাহিদের কথায় আশ্বস্ত হয়। তাকে স্বামী বলে মেনে নেয়। সেই থেকে এসএসআই জাহিদ আর চায়না স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করতে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে কৌশলে চায়নার কাছ থেকে টাকাও আদায় করে সে। চায়নাও সরল বিশ্বাসে নিজের জমানো ব্যাংক হিসাব ও ধার-কর্জ করে দেড় লাখ টাকা তুলে দেয় জাহিদের হাতে। এমনকি তার গলার হার, কানের দুলও বাদ যায়নি। শেষে কমপ্যাক ৪২০ মডেলের একটি ল্যাপটপ বন্ধক রেখে ২৫ হাজার টাকা দেয় জাহিদকে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে এএসআই জাহিদ কুষ্টিয়া জেলার খোকসা থানায় বদলি হয়ে যায়। তার ডাকে চায়নাও ঘর ছাড়ে। একই মাসের ২৬ তারিখ জাহিদ খোকসা এলাকায় তার এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে যায় তাকে। নিজেদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়। কয়েক দিন পর চায়নাকে নিয়ে জাহিদ ওঠে খোকসা থানার সরকারি কোয়ার্টারে। পুলিশি ডিউটিতে যাওয়ার সময় চায়নাকে সে রুমে তালাবদ্ধ করে রাখতো। আবার ফিরে এসে খুলে দিতো। আর এতেই সন্দেহ বাড়ে চায়নার। কোয়ার্টারের অন্য লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারে, তার স্বামীর আসল নাম শেখ জাহিদুর রহমান জাহিদ। আরও জানতে পারে সে একজন প্রতারক। পিরোজপুর ও খুলনার ডুমুরিয়ায় এর আগেও সে দু’টি বিয়ে করেছে। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় নীল হয়ে যায় চায়না। নিজের ভুল বুঝতে পারে। আসল পরিচয় জানার পর থেকেই জাহিদ চায়নার ওপর চালায় শারীরিক নির্যাতন। হুমকি দেয় একথা কাউকে বললে তাকে মেরে ফেলা হবে। উপায়ান্তর না দেখে ১২ই নভেম্বর খোকসা থানা কোয়ার্টার থেকে চায়না পালিয়ে আসে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটায় তার গ্রামের বাড়িতে। পরিচয় প্রকাশ পাওয়ায় এবং চায়না চলে যাওয়াতে জাহিদ আরও ক্ষুব্ধ হয়। ওই রাতেই সে চায়নার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার কাছ থেকে নেয়া সবকিছু ফেরত দেবে বলে অঙ্গীকার করে। চায়নাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। ১৩ই নভেম্বর ভোরে চায়না ছয়ঘড়িয়া গ্রামের গুপ্তমারি শোলমারি নদীর ওপর ব্রিজে জাহিদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। একপর্যায়ে জাহিদ জোর করে চায়নাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চায়। বাধা দিলে জাহিদের কোমরে থাকা দা দিয়ে চায়নাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। চায়নার চিৎকারে নদীতে মাছ ধরতে আসা জেলেরা তাকে উদ্ধার করতে আসে, জাহিদ তাদেরও ধাওয়া করে। একপর্যায়ে লোকজন সংঘবদ্ধ হয়ে জাহিদকে আটক করে। তাকে তুলে দেয় পুলিশের হাতে। আহত রক্তাক্ত ও সংজ্ঞাহীন চায়নাকে কয়েকজন বটিয়াঘাটা সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। অবস্থা গুরুতর হলে ডাক্তাররা তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করে। এদিনই চায়নার মা স্মৃতি মহলদার বাদী হয়ে বটিয়াঘাটা থানায় এএসআই জাহিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মেডিকেল রিপোর্ট ও ডাক্তারদের মাধ্যমে জানা গেছে, দায়ের কোপে চায়নার বাম বাহুর হাড়ের জয়েন্ট আলাদা হয়ে গেছে। যা সারতে দীর্ঘ সময় লাগবে। মাথায়, ঘাড়ে ও হাতেও বড় ধরনের ক্ষত রয়েছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে গত ২৬শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ মাইনরটি ওয়াচের সভাপতি রবীন্দ্র ঘোষের সহযোগিতায় কুষ্টিয়া জেলার খোকসা থানায় এএসআই জাহিদের বিরুদ্ধে চায়না নিজে বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধিত ২০০৩) ধর্ষণ ও প্রতারণার মামলা করে (মামলা নম্বর ০২/২০১২/ ধারা- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধিত ২০০৩) এর ৯(১) ও দণ্ডবিধি ৪২০)। কিন্তু মামলা করার পর থেকেই আতঙ্কে আছে চায়না ও তার পরিবার। মামলা তুলে নেয়ার জন্য পুলিশের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মহল চায়না ও তার পরিবারকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর মধ্যে কারাগার থেকে এএসআই জাহিদ চিঠি লিখে জানায়, “আমার চরিত্র অনেকটা কুকুরের মতো। কুকুর যেমন খাবার দেখলে লোভ সামলাতে পারে না, তেমনি আমিও তোমার সুন্দর শরীর দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। তুমি যখন সব জেনে গেছ এটাও জেনে রাখ, তোমার শরীর ও টাকার জন্যই আমি তোমার সঙ্গে অভিনয় করেছি। মানুষের কাছ থেকে এভাবে নেওয়াটাই আমার স্বভাব। আর আমাকে দেওয়ার মতো তোমার কিছুই নেই। তাই তোমাকে আর এখন ভাল লাগে না।” এ বিষয়ে কথা বললে চায়না মহলদার (টিনা) জানায়, জাহিদকে সঞ্জয় ভেবে আমি ভুল করেছিলাম। সে শুধু প্রতারকই নয়, একজন ভয়ঙ্কর লোক। জাহিদের দায়ের কোপে আমার বাম হাতটি অচল হয়ে গেছে। শরীরের অন্যান্য জায়গাতেও আঘাতের চিহ্ন। শারীরিকভাবে আমি এখন প্রায় অচল। আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমি করছি। আমি চাই না আমার মতো আর কোন মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট হোক। এএসআই জাহিদ মিথ্যা পরিচয় দিয়ে, প্রতারণা করে আমার সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। আজ আমি অসহায়। কিন্তু আমি চাই জাহিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।

Powered by Blogger.