গতকাল সারা দেশেই ছিলো ” মিসড কল দিবস”! জানুন অন্যরকম একটা প্রতিবাদের ভাষা

খুব সকাল থেকেই সারাদিন পরিচিত অপরিচিত অনেক নাম্বার থেকে মিসড কল পাচ্ছিলাম, সেই সকাল বেলা  ঘুম থেকে উঠার আগে থেকেই মিসড কলের বিরক্তিকর
গল্পটা শুরু হলো । মাঝে মাঝে চোখ মেলে পরিচিত নাম্বার থেকে এতো বার মিসড কল দেখে কিছুটা দুশ্চিন্তায়  পড়ে গিয়েছিলাম। চিন্তা বলছি এই কারনে ঐ নাম্বারগুলোতে কল ব্যাক করলে কেওই রিসিভ করছিলোনা ।একরাশ বিরক্তি নিয়ে সকালটা শুরু হলেও দুপুরে এফ, বিতে গিয়ে ছোট ভাই রেজার ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখলাম “আজ  মিসড কল দিবস” ।
- তাই নাকি! অনেক দিবসের নাম শুনেছি এমন আজব দিবসও যে চালু হবে তা’তো  ভাবিনি কখনো ! অনেকটা আশ্চর্য হয়েও ফেবু বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম । ততোক্ষণে ক্রমাগত মিসড কলের রহস্য টাও বুঝে গেছি । পরে ঢাকা পলিটেকনিকে পড়া আর এক ছোট ভাই সানোয়ার পারভেজের পুলকের স্ট্যাটাসে জানতে পারা গেলো বিস্তারিত। কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।  ফেইসবুকের বন্ধু আজনাবি ‘র স্ট্যাটাসে দেখলাম ” বন্ধুরা আমার নাম্বার যাদের কাছে আছে তারা প্রতিবাদ জানাতে আমারে কুপাইয়া মিসড কল দাও :)  ”
পরবর্তীতে আরও ব্যাপক অনুসন্ধানে দেখা গেলো রোববার বাংলাদেশের তরুণেরা ” মিসডকল দিবস”  পালন করছে। আর সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো এই দিবস্ টি পালন করার জন্যই পর্যন্ত প্রায় ৩লাখ মানুষ সম্মতি প্রদান করেছে। রোববার সকাল ১০ থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত মিসড কল দেয়ার পর আবার সন্ধ্যা ৭ থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত সময় ঠিক করা হয়েছে। শুধু মিসডকল নয় সে সাথে স্বতস্ফুর্ত ভাবে চলছে অপর কে আমন্ত্রন জানানো।
কেন এই মিসকল দিবস বিস্তারিত জানার চেষ্টা করতেই জানা গেলো বিস্তারিতঃ 
 আসুন উদ্যোক্তাদের কি উদ্দেশ্য এমন একটি ইভেন্ট করেছে সেটা  জেনে নিই তাদের ভাষায় , 
” প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবেই পালন করা হবে এই মিসকল দিবস। Sedative Hypnotics এবং দূর্যোধন দূর্যোধন নামের দুজন যুবক সোস্যাল মিডিয়া ফেসবুকের একটি ইভেন্টের মাধ্যমে এই উদ্যোগ গ্রহণ করলে তাতে পৌনে ২ লাখ মানুষ সমর্থন জানিয়েছে। কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? আমরা অফলাইনের শান্তিপ্রিয় মানববন্ধনে বিশ্বাস রাখতে পারছি না । যারা এভাবে দিনের পর দিন লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে, তারা আমাদের শান্তিপূর্ন মানববন্ধনে কান দেবে – এটা আশা করা যায় না । সুতরাং আগ্রাসী ভুমিকা নিতেই হয় । তাই আমরা ঠিক করেছি , নির্দিষ্ট একটি তারিখে নির্দিষ্ট সময়ে আমরা সবাই মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্ক ব্যস্ত রাখবো , কিন্তু এক পয়সাও খরচ করবো না ।
আর সেই উপায় হলো মিসড কল ।”
একটি নির্দিষ্ট তারিখে পিক আওয়ারে আমরা সবাই যদি গনহারে পরিচিতজনদের মিসড কল দেয়া শুরু করি , তবে মোবাইল অপারেটরদের বি টি এস ব্যস্ত থাকবে ঠিকই,কিন্তু যেহেতু আমাদের কারও কোনো খরচ করতে হচ্ছে না, তাই আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না । যা ক্ষতি হবার হবে কোম্পানীর,কারন সেই সময় আমরা তাদের নেটয়ার্ক ব্যবহার করেছি ঠিকই কিন্তু কোন টাকা দিচ্ছিনা! আমরা অনেক মানুষ যদি একত্রিত হতে পারি,তবে কোম্পানীর ক্ষতিটা নেহায়েত কম না ।
যদি ৫০০০ হাজার মানুষ ইভেন্টে যোগ দিন এবং প্রত্যেকে তিনঘন্টায় মাত্র ২০ টা মিসড কল করেন , তিনঘন্টায় ১ লাখ মিসড কল হচ্ছে , যেগুলোর অপারেটরদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করলো ঠিকই – কিন্তু কোনো ইনকাম করলো না,বরঞ্চ তাদের সেলুলার ট্র্যাফিক বিজি করে রাখছে ! তাছাড়া এই সংখ্যা যদি আরো বিশাল হয়,তবে আমাদের দাবীর প্রতি তাদের কর্নপাত করতেই হবে । আমরা জানি , এই সংখ্যাটা ২০০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে , ক্ষতিটা আক্ষরিক অর্থেই বেশি হবে ।
জয়েন আস !
- যেহেতু সরকার খরচ কমিয়েছে,সুতরাং যৌক্তিকভাবেই কম খরচে ইন্টারনেট সার্ভিস চাই ।
- স্প্যাম ম্যাসেজের অবসান চাই ।
- ভালো নেটওয়ার্ক চাই ।

missd.jpg
-
তারা আরও জানালো , সম্পূর্ন অনলাইনে এই প্রতিবাদ, এর জন্য আপনার রাস্তায় থাকা দরকার নেই । আপনি আপনার বাসায় বসেই,অফিসে থেকেই অথবা যাত্রা পথেও আমাদের সাথে সংযুক্ত হতে পারেন । আপনি সিলেট থাকতে পারেন , আপনি ঢাকায় থাকতে পারেন , আপনি ভোলায় থাকতে পারেন – কিন্তু আপনি একইসাথে বাকি সবার সাথে এই অভিনব প্রতিবাদে অংশ নিতে পারেন । আপনি অফলাইনে বা অনলাইনে আপনার বন্ধুদের সাথে কথা বলুন , সবাইকে জানান - আমরা এইভাবে আর ডাকাতি দেখতে পারি না । সবাইকে জানান,এবার আমরা তাদের গাঁট কাটবো ।
সবাই বোঝান – অপারেটরদের না ভোগালে তারা আমাদের কথা শুনছে না । সবাইকে বলুন – প্রিন্ট মিডিয়া বিজ্ঞাপনের টাকা উপার্জন করে অপারেটরদের কাছে জিম্মি ,আমাদের ভোগান্তির কথা কখনোই ছাপাবেনা, তারা আমাদের পক্ষে অপারেটরদের উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট নিয়ে কখনোই বলবে না ।
আমরা ফেসবুককেই বেছে নিয়েছি সবার সাথে একত্রিত হবার স্থান হিসেবে , এখান থেকেই শুরু হবে সেই প্রতিবাদের ভাষার….. যা অপারেটরদের বাধ্য করবে সার্ভিস চার্জ কমাতে ।
শুধু নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট কয়েকটি ঘন্টা আপনি মিসড কল করে যান, ২০…৩০…৫০ টি ।যত বেশি মিসডকল করবেন, আমাদের কাছে অপারেটরদের মাথা নত করার সম্ভাবনা ততই বাড়বে ।
একই ইভেন্টে তারা আহব্বান করেছে ,
” অনেক তো ভুগেছি ,আসুন এবার তাদের ভোগাই ।
স্থান: আপনার মোবাইল
সময়: রবিবার সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১ টা।
কি করতে হবে : রবিবার ১০টা-১টা গনহারে পরিচিতজনদের মিসড কল দেয়া
কারন এবং এতে কি লাভ : মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট প্যাকেজের দাম কমাতে বাধ্য করা মূল উদ্দেশ্য’
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো ‘২০০৬ সালে গ্রামীনফোন বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা EDGE শুরু করার আগ পর্যন্ত ডায়াল আপ কানেকশনই মূল ভরসা ছিলো । VSAT এর মাধ্যমে এতদিন দিয়ে যাওয়া ধীরগতির ইন্টারনেট সার্ভিস কিছুটা গতি পায় ২০০৬ সালে , যখন বাংলাদেশ যুক্ত হলো ISCC(International Submarine Cable Consortium) এর SEA-ME-WE-4 কেবলে । ব্যান্ডউইডথের দামও তখন ছিলো অবিশ্বাস্য রকমের বেশী – প্রতি মেগাবিট ব্যান্ডউইডথের দাম ছিলো ৮০০০০ হাজার টাকা,ইন্টারনেট তখনো তরুনদের হাতে সহজলভ্য হয় নি, গনমানুষের কাছেও না । ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতি মেগাবিট ব্যান্ডউইডথের দাম কমিয়ে দেন ২৭০০০ টাকায় । এর পরপরই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার । ইন্টারনেট সার্ভিস তৃনমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেবার প্রত্যাশায় তারা এক এক ধাপে ব্যান্ডউইডথের দাম কমানো শুরু করে । ২৭০০০ টাকা থেকে তারা ২০০৯ সালে প্রতি মেগাবিট ব্যান্ডউইডথের দাম কমিয়ে আনে ১৮০০০ টাকায়, পরবর্তীতে ২০১২ সালে আবারো কমিয়ে আনে ৮০০০ টাকায় । একইসাথে পরবর্তীতে প্রতি মেগাবিট ব্যান্ডউইডথের দাম ৮০০০ থেকে ৫০০০ টাকায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে BTRC .
কেন দাম কমাচ্ছে ?
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট সার্ভিস তৃনমূলে পৌঁছে দেয়ার কথা সরকার বলছে । একইসাথে সরকার জানাচ্ছে বাংলাদেশ SEA-ME-WE-4 সাবমেরিন কেবলে যুক্ত থেকে ৪৪.৬ গিগাবিট ব্যান্ডউইডথ পেলেও ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ১৫ গিগাবিট ব্যান্ডউইডথ । তাছাড়া ২০১৩ সালের জুনে আরো ৯৬ গিগাবিট ব্যান্ডউইডথ যুক্ত হতে যাচ্ছে । এই বিশাল পরিমানের ব্যান্ডউইডথ যেন অব্যবহৃত না থাকে, সেই জন্য এবং আই এস পি (ISP) ও মোবাইল অপারেটরদের চাপে সরকার দাম কমিয়েছে ।
এই কমদামে বিক্রি করা ব্যান্ডউইডথের সুফল কি আমরা পাচ্ছি ?
না । আপনাদের মনে থাকার কথা , ২০০৬ সালে EDGE সার্ভিস চালু করা গ্রামীনফোনের ইন্টারনেট খরচ এখনো সেই আগেরমতই আছে । ২০০৯ সালের ১ জিবি ইন্টারনেটের প্যাকেজের দাম এখনো ৩৫০ টাকাই আছে ।এর মাঝে সরকার ঠিকই দুই দফায় দাম কমালেও তারা কমায় নি । একই কথা খাটে বাংলালিংক,এয়ারটেল,রবি সহ অন্যান্য অপারেটরদের ক্ষেত্রেও । সবাই .০২ কিলোবাইট / পয়সা হিশাবে আমাদের কাছ থেকে ইন্টারনেটের চার্জ নিচ্ছে ।
আপনারা খেয়াল করুন, প্রতি ১০ মেগাবাইট ইন্টারনেটের প্যাকেজ এয়ারটেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১০ টাকা (ভ্যাট ছাড়া)পড়বে , অথচ একই কোম্পানী ভারতে (টুজি নেটওয়ার্কে) ১০ রুপীতে (বাংলাদেশী ১৪.৮০ পয়সা) ১২৫ মেগাবাইট ইন্টারনেট দিচ্ছে ! একইভাবে বাংলাদেশের গ্রামীনফোনের মূল কোম্পানি টেলিনরের ভারতীয় অংশ ইউনিনর ৯ রুপিতে (বাংলাদেশি ১৩.৩০ পয়সা) ৬০ মেগাবাইট ইন্টারনেট দিচ্ছে ! বাংলালিঙ্কও চালাচ্ছে ১০ মেগাবাইট ১০ টাকার প্যাকেজ, রবিও সেই একই ডাকাতি চালিয়ে যাচ্ছে । এভাবেই সরকার দাম কমিয়ে গেলেও আমজনতা কোনো রেহাই তো পাচ্ছেই না, বরঙ অন্য দেশের তুলনায় আমাদের কাছ থেকে দামও বেশী রাখা হচ্ছে ।
শুধু ইন্টারনেটের খরচই বেশি ?
না । আমরা এত উচ্চমুল্যে ইন্টারনেটের নামে যা কিনছি আমাদের কষ্টার্জিত পয়সায়,তার স্পীড নিয়ে কে সন্তুষ্ট ? গ্রামীনফোনের এভারেজ স্পীড থাকে ১০-১৯ কেবিপিএস , বাংলালিংকের অবস্থা আরো খারাপ । রবি কি দিচ্ছে তা কেউই বলতে পারছেনা , এয়ারটেলও তার ব্যতিক্রম নয় । অথচ টু-জি কানেকশনের স্পীড ৩৮৪ কিলোবিট পার সেকেন্ড পর্যন্ত হতে পারে, আমরা টাকা দিয়ে কতটুকু পাচ্ছি ? একইসাথে প্রতিদিন বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর দিনে-রাতে গাদাগাদা স্প্যাম ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে । কখনো ‘ভালো মুসলিম পাত্রীর খবর’ জানাতে (বাংলালিংক) , কখনো ‘আমি রেশমা,বন্ধু হতে ডায়াল করো **** নাম্বারে’ (এয়ারটেল) ইত্যাদি বিব্রতকর ম্যাসেজ । তাছাড়া সরকার ১০ সেকেন্ড পালস রেট নির্ধারন করে দেয়ার পর কল ড্রপের ( হুট করে কানেকশন কেটে যাওয়া ) পরিমান বেড়ে গেছে ! দরকারে কাস্টোমার কেয়ারে ফোন দিতে হলেও টাকা কাটছে, অথচ বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালের আগস্টে সব টেলিকম কোম্পানীকে নির্দেশ দিয়েছিলো- ১২১ নাম্বারে টোল ফ্রি রাখতে,অর্থাত এই নাম্বারে ফোন করা হলেও যেন টাকা কাটা না হয় । সেই নির্দেশও কি এরা মেনেছে ? বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে টিভি-পত্রিকা ছেয়ে ফেলার দিকে এদের যত মনোযোগ , ঠিক ততই অনীহা ইউজারদের সুবিধা দেখার ক্ষেত্রে ।
উল্লেখ্য, Sedative Hypnotics ও দূর্যোধন দূর্যোধন নামে দুই যুবক এই উদ্যোগ গ্রহন করলে তাতে দেশের প্রায় ৩ লাখ মানুষ সমর্থন জানিয়েছে। এই উদ্যোগের পূর্বে মোবাইল অপারেটর কোম্পানীর গুলো সাথে প্রতিবাদের কারন নিয়ে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানী গুলো তাদের দাবির ব্যাপারে কোন সাড়া প্রদান করে নি।
এতে উদ্যোগের গতি দ্বিগুন হয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এমনকি এই প্রতিবাদ কয়েকদিন পর পর হবেও বলে জানিয়েছেন তারা। আর এই মিসডকল এর ইভেন্ট কে ঘিরে উন্মাদনায় মেতেছে তরুনেরা। শুধু নিজেরা নয়, তরুণেরা তাদের আত্মীয় স্বজন এমন কি মা বাবাকেও উতসাহিত করছে তারা।
সব জেনে অবশেষে মনে হলো ব্যাতিক্রমি এই উদ্যেগটা নিঃসন্দেহে ভালো । আসুন সবাই মিলে পরবর্তী কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়ে ” মিসড কল দিবস ” পালনে সচেষ্ট হই , অন্যদেরও উৎসাহী করি ।
source: হ্যালো-টুডে ডটকম

Powered by Blogger.