এফএম রেডিও : রাতের আয়োজন ! অর্থহীন গালগপ্পো আর যৌন সুড়সুড়ি!!

হ্যাল্‌লো লিসেনার, দিজ ইজ শাওন, ঘড়ির কাঁটায় এখন ঠিক রাত একটা বেজে পনের মিনিট। ফুল নাইট আছি আপনাদের সাথে। এখন আপনাদের শোনাবো ড্যাশিং ডুসিং ফাটাফাটি একটা গান; আর এ গানটির জন্য রিকুয়েস্ট করেছেন ভিকারুননিসা থেকে আফসানা, নটরডেম থেকে ইমতিয়াজ, যাত্রাবাড়ি আইডিয়াল স্কুল থেকে নওশাদ...শুনুন তাহলে
রিমিক্স এবং নতুন ভ্যারিয়েশনে সেই গানটি...``সোনা বন্ধু তুই আমারে ভোতা দা দি কাইট্টা লা...পিরিতির কাথা দিয়া যাইত্তা ধইরা মাইরা লা।``

শুক্রবার দিবাগত রাতে একটি এফএম রেডিওর আরজে (রেডিও জকি) এভাবেই শ্রোতাদের অনুরোধে (!) যৌন সুড়সুড়িমূলক গান শোনাতে থাকেন। রাতজুড়ে চলে টিএনএজ বয়সীদের প্রেম, অশ্লীল কথাবার্তা। কখনো শ্রোতাদের অনুরোধে আবার কখনো আরজে নিজ থেকেই শোনান বিভিন্ন গান। রাত দু`টায় আরেকটি সুড়সুড়িমূলক গান শোনানোর আগে আরজে বলেন, ``লিসেনার, এখন শোনাবো তারুণ্যের মারদাঙ্গা আরেকটি গান, আই হোপ মিডনাইটে গানটি আপনাদের আনন্দ দেবে, কি গান?`` এরপর গান বাজে- ``মন চাইলে মন পাবি দেহ চাইলে দেহ, সবই হবে অগোচরে জানবে না কেহ``

গত সপ্তাহজুড়ে রাতে দেশের এফএম রেডিও চ্যানেলগুলো শুনে বোঝা গেছে রাতজুড়ে রেডিওর এসব প্রোগ্রামের শ্রোতারা তরুণ-তরুণী ছাড়াও টিএনএজ শ্রোতারা। বর্তমানে দেশে প্রায় দশটি রেডিও চ্যানেল রয়েছে। বেশিরভাগ চ্যানেলে রাতের প্রোগ্রামে যারা আরজে থাকেন তারা ফোনে এবং ক্ষুদেবার্তায় টিএনএজ প্রেমকাহিনী শোনান আরজেকে। যৌন সুড়সুড়িমূলক কথাবার্তাও উঠে আসে আরজে ও শ্রোতাদের আলোচনায়।

শ্রোতাদের মধ্যে আছে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরাও। আরজে তাদের সমস্যা শোনেন তারপর সমস্যার সমাধান দেন। মুশকিল-আসানকারী হয়ে যান রাতের প্রোগ্রামের আরজে।

বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন গান, ফান ও বেসামাল বিনোদিত এক জীবনের দীক্ষা দেওয়া হচ্ছে এফএম রেডিওর এসব মিডনাইট প্রোগ্রামে।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ``গণমাধ্যমই সমাজ ও রাষ্ট্রের সমকালীন চিন্তা, চেতনা ও আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু ঘুমতাড়ানিয়া প্রোগ্রামগুলোতে এখন নিছক বিনোদন ছাড়া আর কিছু নেই। বিনোদন বললেও তা কোন পর্যায়ের তা দেখার সময় এসেছে।``
তিনি বলেন, ``উন্নত বিশ্বে দেশের সরকারী ও বেসরকারী রেডিও চ্যানেলগুলো দেশের শিক্ষা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাপান সরকার দেশের নিরক্ষরতা দূর করতে টিভি ও রেডিওকে অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলো।``

ভাষাসৈনিক আহমেদ রফিক মনে করেন, কিছু রেডিও চ্যানেল ভাষার বিকৃতি ঘটাচ্ছে।

তিনি বলেন, ``বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মিশ্রণে ভাষার জগাখিচুড়ি চলছে। অনেকদিন লক্ষ্য করছি, এটা বন্ধ হচ্ছে না।এসব প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া উচিত।``

পিপলস রেডিওর প্রডিউসার ও আরজে সাদেক সামী বাংলানিউজকে বলেন, ``এটা ঠিক রেডিওর শ্রোতাদের বড় অংশ টিএনএজার।``

‘‘কিছু কিছু চ্যানেলে ও রেডিওতে অমার্জিত কথা হয়’’ স্বীকার করে তিনি বলেন, ``টেলিভিশন বা পত্রিকায় বিভৎস ছবি না দেখানো নিয়ে নিয়ম-নীতি আছে, কিন্তু কোনো রেডিও চ্যানেলে সেরকম নিয়ম-নীতি নেই। কথা বলার সময় কোন পর্যায় পর্যন্ত কথা বলা যাবে কিংবা শ্রোতাদের সঙ্গে আরজে দুষ্টুমি করলেও সেটা কোন পর্যায় পর্যন্ত করা যাবে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেম না থাকায় বিভিন্ন প্রোগ্রামে অপ্রীতিকর কিছু বিষয় চলে আসছে।``

এদিকে রাত জেগে এফএম রেডিও শোনায় বিঘ্ন ঘটছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায়ও।

আবদুল আহাদ নামের একজন অভিভাবক বলেন, ``নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীতে ওঠার পর দেখি আমার ছেলের রেজাল্ট ভয়াবহ খারাপ। ঘুমের জন্য প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারে না। একদিন সকালে আমি ছেলের রুমে গিয়ে দেখি কানে হেডফোন। হেডফোন কানে নিয়ে বুঝতে পারি এভাবেই প্রতিরাতে রেডিও শুনছে আর শুনতে শুনতে শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়ে তাই স্কুলেও যেতে পারে না। ফলে রেজাল্ট খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক।``

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক গোলাম রাব্বানী বাংলানিউজকে বলেন, ``রাত জেগে রাতের প্রোগ্রামগুলো শোনার কারণে অনেক শিক্ষার্থীকে আমরা দেখি ক্লাসে তাদের ঘুম ঘুম চোখে দেখা যায়।``

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মোহিত কামাল বলেন, ``রাতের এসব প্রোগ্রামের কারণে শিক্ষার্থীরা জেগে থাকার কারণে তাদের শরীর ও মন দুটোর ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।`` অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেন তিনি।

রাত জেগে এসব শোনার কারণ জানতে চাইলে নিয়মিত রাতের আয়োজন শোনা ভিকারুননিসা নূন হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফরিদা আফরিন বলেন, ``রাতের আয়োজনগুলোতে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে রাখার মতো আয়োজন থাকে। সরাসরি ফোনে যোগাযোগ করা যায় ফলে সুখ-দু:খের কথা বলতে পারি।``

অর্থহীন গাল-গল্পের মধ্যে গভীর হয় রাত
এফএম রেডিওতে রাতের অধিকাংশ প্রোগ্রামে থাকে অর্থহীন গালগপ্পো আর যৌনতার সুড়সুড়ি। ‘সানডে নাইট’ রেডিও আমার’র রবিবার রাতের একটি আয়োজন। আঞ্চলিক ভাষার একটি উম্মুক্ত আড্ডা অনুষ্ঠান। এখানে সিলেট, উত্তরবঙ্গ ও নোয়াখালী অঞ্চলের ভাষাভাষী তিনজন লোক থাকে। তারা নানা বিষয়ে মজার মন্তব্য করার চেষ্টা করে । উঠতি তরুণ-তরুণীরা তাদের সঙ্গে ফোনে যোগদান করে। তাদের থাকে না কোনো বিষয়। থাকে না কোনো বাধা। শালীন ও অশালীন নানা কথা ও মন্তব্য হয় সেখানে। দিন কয়েক আগে একটি অনুষ্ঠানে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর পর যখন অনুষ্ঠানের সঞ্চালকদের তিনি বাসায় আমন্ত্রণ করেন তখন তারা উত্তর দেয় তাদের পক্ষে তার বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার বাসায় গেলে একটি বিপদের আশঙ্কা আছে। এমন অশালীন ইঙ্গিতে ওই নারী দ্রুত ফোন কেটে দেন।

‘ভূত’ এফএম রেডিও ফূর্তির শুক্রবার রাতের আরেকটি আয়োজন। এখানে প্রতি সপ্তাহে কয়েকজন অতিথি আগমন করেন। তারা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ভূতের গল্প বর্ণনা করেন।

‘রেডিও আমার’ নামক এফএম চ্যানেলটিতে  ‘আমার ভালোবাসা’ একজন অতিথি তার জীবনের ভালোবাসার গল্প বলতে আসেন। এ অনুষ্ঠানে পুরুষ কিংবা নারী যে অতিথিই আসেন তাদের কাজই হলো যার সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়েছে তার চরিত্রহরণ করা। এ অনুষ্ঠানের সঞ্চালককে বলা হয়  লাভগুরু। প্রেম-বিরহের সকল সমাধানই যেন মেলে এই লাভগুরুর কাছে! - বাংলানিউজ

,
Powered by Blogger.