বৈঠকের কথা বলে গুলশানে নিয়ে যাওয়া হয় মিল্কিকে

তারেক ও চঞ্চলের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকের কথা বলে গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডে নিয়ে যাওয়া হয় রিয়াজুল হক খান মিল্কিকে। ওই রাতে রিয়াজুল সেখানে কেনাকাটার জন্য যাননি। বৈঠকে অংশ নিতেই গিয়েছিলেন, তথ্য যুবলীগের একটি সূত্রের। রিয়াজুল সেখানে যাওয়ামাত্রই ঘটে গুলির ঘটনা। পাল্টা গুলির ঘটনাও ঘটে সেখানে। পাল্টা গুলিতেই আহত হন জাহিদ সিদ্দিকী তারেক। তারেক ও রিয়াজুলের মধ্যে সম্পর্কের
চিড় ধরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। এ সময়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। রাজধানীর মুগদাপাড়া, বাড্ডা ও গুলশান এলাকার লর্ড বলে পরিচিত যুবলীগ নেতা চঞ্চলের সঙ্গে সমপ্রতিকালে মিল্কির বিরোধ চরমে উঠে টেন্ডার বাণিজ্য ও মুগদাপাড়া এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। এক সময়ে মিল্কি, তারেক ও চঞ্চল ছিল একই সঙ্গে। অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণের মধ্যদিয়েই তাদের সখ্য সৃষ্টি হয়। আবার সেখান থেকেই বিরোধের সূত্রপাত। তিনজনের বিরোধ গড়ায় যুবলীগের ওপর পর্যন্ত। মহানগর যুবলীগের অনেক নেতাই জড়িয়ে পড়েন ওই বিরোধে। সূত্রমতে ওই বিরোধের সুযোগ নেয় মতিঝিল কেন্দ্রিক একটি পক্ষ।ঘটনার রাতে রিয়াজুল হক খান মিল্কির গুলশানে যাওয়ার বিষয়টি রীতিমত রহস্যময়। মিল্কি যেখানেই যাক তার প্রাইভেটকারের চালকই গাড়ি চালায়। কিন্ত ওই রাতে তার গাড়িচালক বেলালকে রেখে যাওয়া হয়। বেলালের বদলে ওই রাতে মতিঝিলের যুবলীগ নেতা সাগর গাড়ি চালিয়ে গুলশান নিয়ে যায় মিল্কিকে। গাড়িচালক বেলালকে রেখে সাগর কেন সে রাতে গাড়ি ড্রাইভ করল? এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তারেক ও মিল্কির মতই মিতিঝিল এজিবি কলোনিতে বেড়ে উঠেছে যুবলীগ নেতা সাগর। বর্তমানে ধানমন্ডিতে বসবাস করলেও তাদের রাজনীতির কেন্দ্র মতিঝিল। সাগরদের আদি বাড়ি মাদারীপুরে। তারা পিতা চাকরি করতেন বিদ্যুৎ বিভাগে ইলেকট্রিশিয়ান পদে। যুবলীগের সুবাধে সাগরও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। মতিঝিল কেন্দ্রিক নির্বাচনী রাজনীতির স্বপ্ন দেখেন সাগরও। তারেক ও রিয়াজুলের মধ্যে বিরোধ বাধলেও সাগর সদরে ভেতরে দু’জনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতেন। ওই সম্পর্কের সুবাধেই তারেক ও মিল্কির বিরোধ মীমাংমার উদ্যোগ নেয় সাগর।
যুবলীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, মতিঝিলে কমিশনার প্রার্থী হওয়ার রাজনীতিতে একেবারে সুপরিকল্পিত ছক অনুসারে কাজ হয়েছে।
একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করেছে আড়ালের মহল। এখানে কমিশনার প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন মিল্কি, তারেক ও আওয়ামী লীগ নেতা টিপু। এ নিয়ে তারেক ও মিল্কির মধ্যে বিরোধ থাকলেও টিপু কোন বিরোধে নেই। তিনি তার মতো আলাদা রাজনীতি করেন। কিন্তু গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর দেখা গেল সন্ত্রাসী হামলায় মারা গেলেন কমিশনার মনোনয়ন প্রত্যাশী মিল্কি, র‌্যাবের ক্রসফায়ারে মারা গেলেন তারেক। মিল্কি হত্যার আসামি হয়ে এখন ফেরারি আওয়ামী লীগ নেতা টিপু। আড়াল থেকে ছোড়া এক ঢিলে দুই নয় মতিঝিলের তিন নেতাই খতম। মতিঝিল এলাকার টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে কমিশনার প্রার্থী হওয়া পর্যন্ত মাথা তোলা নেতা এখন সাগর একা।
একটি সূত্র জানিয়েছে, গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে মিল্কি হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই হত্যার পরিকল্পনা ছিল তারেককে। সেভাবেই সাজানো ছিল ছক। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল মিল্কি শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে পৌঁছামাত্রই তাকে গুলি করা হবে এবং মিল্কি মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্যরা গুলি করবে তারেককে। ঠিক সেভাবেই গুলি করা হয় তারেককে। কিন্তু মোটরসাইকেল দ্রুত চলে যাওয়ায় গুলি লাগে তারেকের পিঠে। সে রাতে আহত অবস্থায় উত্তরার ফরচুন নামের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি হন তারেক। সেখানে থেকেই র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে। ওই রাতে মতিঝিল ছাত্রলীগের নেতা ঘাতক সোহেল কি কারণে শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে গিয়েছিল? রহস্য ঘেরা সে বিষয়টিও। একটি সূত্র জানিয়েছে, সোহেল গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরই পেছন থেকে তারেককে গুলি করে যুবলীগ নেতা সাগর। হত্যাকাণ্ডের পর সাগরকে আটক করে ছেড়ে দেয় র‌্যাব। সাগরকে কেন ছেড়ে দেয়া হলো অস্পষ্ট সে বিষয়টিও। এখন নিহত রিয়াজুল হক খান মিল্কির ভাইপো পরিচয়ে সাগরই গণমাধ্যমকে নানা তথ্য দিচ্ছে। যদিও নিহত মিল্কির গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায় এবং সাগরের বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। ঢাকা মহানগর যুবলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ওই রাতে বৈঠকের কথা বলে কেন মিল্কিকে গুলশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সে বিষয়টির ফয়সালা হলেই বেরিয়ে আসতে পারে মিল্কি হত্যার আসল রহস্য।
তারেক নিহত হওয়ায় মিল্কি খুনের রহস্য বাড়ছে
যুবলীগ নেতা তারেক ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনায় মিল্কি খুন নিয়ে রহস্য আরো ঘনিভূত হয়েছে। ৩১শে জুলাই রাতে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন তারেক। তার আগে দেহে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাজধানীর উত্তরার ফরচুন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ওই যুবলীগ নেতা। অসুস্থ থাকার কারণে তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি ওই দিন। দীর্ঘ দুই দশকের ঘনিষ্ট দুইজনের মধ্যে হঠাৎ এমন কি ঘটনা ঘটলো যে কারণে একজন আরেকজনকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন। তারেক কি কারণে মিল্কিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা কেবল তারেকই বলতে পারতো। ওই হত্যাকান্ডটি কি কেবল তারেকই ঘটিয়েছিল নাকি এর পেছনে যুবলীগের অন্য কেউ জড়িত সে বিষয়টি তারেক নিহত হওয়ায় অজানাই থেকে গেল। মিল্কি হত্যার পর আরেকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে আসলে পায়জামা পাঞ্জাবি ও টুপি পরা অস্ত্র হাতের ওই কিলার তারেক না যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। ওই প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া যেত তারেকের কাছ থেকে। ক্রসফায়ারে নিহত তারেকের রিমান্ড চেয়েছিল গুলশান থানা, আদালত তার সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিল। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই পাওয়া যেত মিল্কি খুনের আসল রহস্য। বের হয়ে আসতো আসল খুনি কে তারেক না চঞ্চল? যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসএস জাহিদ সিদ্দিকী তারেক র‌্যাব ফেফাজতে নিহত হওয়ায় এখন নানা কথা শোনা যাচ্ছে বাতাসে। বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই ঢাকাতে দখল, টেন্ডার, চাদাঁবাজী সহ নানা অপকর্মে যুবলীগের কতিপয় নেতার জড়িত থাকার বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছে। মাঠ পর্যায়ের ক্যাডার গোছের কর্মীদের দিয়ে অবৈধ পথে আয়ের টাকা নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে ঢাকা মহানগর ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের কয়েক নেতা। ওই বিষয়টিতে বিশেষভাবে আলোচনায় আছেন যুবলীগের কয়েকজন তরুণ নেতা, তাদের মধ্যে একজন সংসদ সদস্যের নাম আলোচনার শীর্ষে। ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা দলের ভদ্র শিক্ষিত ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে কমিটিতে স্থান দিয়েছে হত্যা সহ বিভিন্ন ধরনের মামলার আসামি ও ক্যাডারদের। এছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লার সন্ত্রাসী থেকে ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবসায়ী বনে যাওয়া গডফাদারদেরকে কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। মহানগর যুবলীগে বাণিজ্য নিয়ে আসল বিরোধ ওই সকল গডফাদার নেতাদের মধ্যে। তাদের বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে দলের মহানগর ও কেন্দ্রের অর্থলোভী নেতারা। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যার পেছনে ওই সকল প্রভাবশালী অর্থলোভী নেতারা জড়িত কি না তারেক জীবিত থাকলে হয়তো তা প্রকাশ হয়ে পড়তো। যুবলীগের অনেক নেতা মনে করেন ওই কাহিনীগুলো যাতে প্রকাশিত না হয় সে কারণেই তারেককে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল তার সহযোগীরা। সে সময়েই র‌্যাবের গুলিতে নিহত হন তারেক।
চঞ্চল কোথায়?
ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যাকান্ডের কিলিং মিশনে অংশ নেয়া ঢাকা মহানগর যুবলীগ উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলের অবস্থান নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলছেন তাকে রাজধানীর গুলশান এলাকার একটি বাড়ি থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করেছে? তবে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছে এমন বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার অবস্থান নিয়ে নানা গুজব রয়েছে। গতকাল রাত পর্যন্ত তার বিষয়ে নিশ্চিত কোন তথ্য দিতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।  মানবজমিন

,
Powered by Blogger.