যৌনতাকে পুঁজি করে ব্যবসা-তারা একসঙ্গে সিনেমা দেখে, সুযোগ পেলে গায়ে হাত দেয়

যৌনতাকে পুঁজি করে ব্যবসা রাজধানীতে নতুন কোনো কিছু নয়। অমর্যাদাকর এই যৌন বাণিজ্য বন্ধে বহু বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এই বাণিজ্য। ফলে এর সঙ্গে জড়িত নারী ও শিশুরা অবহেলিত থাকার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে যৌন বাণিজ্যের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে, তেমনি বদলে যাচ্ছে ব্যবসার কৌশলও। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যসহ নামধারী কিছু সাংবাদিকও নিয়ন্ত্রণ করছে যৌন বাণিজ্য। নারী ও শিশুর শরীরকে পণ্য করে রাজধানীতে এই খাত থেকে সপ্তাহে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। যৌন বাণিজ্যের নেটওয়ার্ক নিয়ে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে নানা চমকপ্রদ তথ্য।
সিনেমা হল : ভাড়াটে বান্ধবী
সন্ধ্যা ছয় টা। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা পরিচিত একটি সিনেমা হল। চারপাশে ব্যস্ত মানুষের ঘরে ফেরার প্রস্তুতি, যানবাহনের জন্য চিরচেনা অপেক্ষা। সিনেমা হলটিতে দিনভর লোক সমাগম কম হলেও সন্ধ্যার পর থেকে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। একটু দূরেই ট্রাফিক পুলিশের কন্ট্রোল রুম। হলের সামনে রিকশা, ভাসমান দোকান। বেশ রমরমা অবস্থা দেখে ‘চলচ্চিত্র শিল্পে সুদিন আসছে’ মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা তেমনটা বলে না। হলটির কাউন্টার ম্যানেজারের কাছে জানা গেল, ‘ব্যবসার অবস্থা ভাল না। কোনো শো-ই হাউসফুল হয় না। প্রায় অর্ধেক সিট খালি পড়ে থাকে। তবে এই সময়টাতে বেশ গ্যাদারিং হয়, আশপাশে অনেক লোকজন থাকে। সবাই তো আর সিনেমা দেখার জন্য আসে না।’ তাহলে কেন আসে? বহুবার প্রশ্ন করা হলেও বরাবরই নিশ্চুপ কাউন্টার ম্যানেজার। পাশ থেকে এক নিরাপত্তারক্ষী জানালেন, ‘শো শুরু হচ্ছে, বাইরে কিছুক্ষণ থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন।’
সন্ধ্যা সাড়ে সাত টা। অপেক্ষা লোক সমাগমের রহস্য জানার জন্য। কিছুক্ষণ বিক্ষিপ্তভাবে ঘোরাফেরা করার পর অবশেষে নজর কাড়তে সক্ষম হই। শীর্ণদেহী এক লম্বা তরুণ এসে এভাবে ঘোরাফেরা করার কারণ জানতে চায়। ‘কিছু লাগলে বলেন’ অযথা ঘোরাফেরা করেন ক্যা?’ তার কথায় একটি ইঙ্গিত পেয়ে মনোযোগী হই, একটি সিগারেটের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলি আরও কিছুক্ষণ। দূর থেকে কেউ একজন হাত নেড়ে পুলিশ বক্সের দিকে যেতে ইঙ্গিত করে। সেদিকে পা বাড়াই। রাস্তার মাঝখানেই পুলিশ বক্স, একপাশটা বেশ অন্ধকার। আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে আছে তিনজন, সকলেই বোরকার আদলে মুখ ঢেকে রেখেছে। পায়ের চপ্পল আর নিজেদের মধ্যে কথা বলার ধরণ দেখে আঁচ করা গেল তাদের সম্পর্কে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে কথা বলতে রাজি হলেন একজন। ঠিক হলো মিরপুরেই একটি বোর্ডিংয়ে গেলে ৫শ’ টাকা দিলেই কেবল তারা মুখ খুলবেন। এই টাকাটার তিনশ’ই সেই বোর্ডিং এ দিতে হবে। বাজেট কম বলে ফিরে আসার চেষ্টা করি এবারঃ। তখন পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘ট্যাকা কম হইলে অন্য কিছু হবে না, লন হলে একসঙ্গে সিনেমা দেখিঃ খুশি কইর‌্যা দিবো। দুইশ টাকা দিলেই হবে। টিকেট আপনে কাটবেন।’
সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সিনেমা হলগুলোকে কেন্দ্র করে এক ধরনের যৌন বাণিজ্য দিন দিন বাড়ছে। সিনেমা দেখার নাম করে খদ্দেরদের সঙ্গে নিয়ে হলের ভেতরেই চলে নানা অনৈতিক কর্মকান্ড। দালাল এবং খদ্দেরের কাছে এরা ‘ভাড়াটে বান্ধবী’ বলে পরিচিত। সিনেমা দেখার এই বিশেষ বান্ধবীরা একশ্রেণির দালাল ম্যানেজ করে হলের ভেতরে প্রবেশ করে। আর টাকাওয়ালা খদ্দের পেলে তাদের শেষ গন্তব্য হয় আবাসিক হোটেল কিংবা বোর্ডিং নামের অন্ধকার ঝুপড়ি ঘর। আর এই ‘ভাড়াটে বান্ধবী’রা সবকিছু বিলিয়ে দেওয়ার পর পায় একশ এবং দুইশ টাকা। বাকি টাকা চলে যায় বোর্ডিং, সিনেমা হলের দালালদের পকেটে। আর সন্ধ্যা থেকে রাত এবং দুপুর থেকে সন্ধ্যা দুই শিফট ভাগ করে কাজ করে এই ভাড়াটে বান্ধবীরা। একেকজন দৈনিক আয় করে কমপক্ষে সাতশ থেকে এক হাজার টাকা। প্রায় ১৫ টি সিনেমাহলকে ঘিরে কমপক্ষে ২০ জনের একাধিক গ্র“প থাকে। গ্র“পগুলো নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ছিচকে ছিনতাইকারী-মাদকাসক্ত একাধিক চক্র। আর তাদের গতিবিধির সব তথ্যই থাকে স্থানীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে, মেলে মাসোয়ারও। তাই তারা রহস্যজনক কারণে তারা নীরব থাকেন। অসমর্থিত একটি সূত্র দাবি করেছে, ‘দায়িত্বশীলদের সঙ্গে দৈনিক চুক্তি-ই এই নীরবতার কারণ।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দালাল ও হোটেল-বোর্ডিং কর্মচারী বলেন, ‘ভাই, আমরা এই ট্যাকা একা খাইনা, হগল রে দিয়া হালাল কইর‌্যা খাই।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে এক সিনেমা হল কর্মচারী বলেন, ‘এমনিতেই হলের অবস্থা খারাপ। ভেতরে তো খারাপ কিছু হয় না। তারা একসঙ্গে সিনেমা দেখে, সুযোগ পেলে গায়ে হাত দেয়। আর কিছু ভেতরে করার সুযোগ নাই। কেউ কেউ সময় কাটানোর জন্য আসে। বেশি কিছু করলে সেটারও জায়গা আছে, তারা সেখানে যায়। পোষাক দেখে তো আর মানুষ চেনা যায় না। এরা গরীব, প্যাটের দায়ে করে, কিন্তু আশপাশে যারা থাকে সবাই তো এ থেকে টাকা খায়।’
বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র আরও জানায়, রাজধানীতে ‘ভাড়াটে বান্ধবী’ শুধু সিনেমা হলকেন্দ্রিক নয়, বিভিন্ন বিনোদন পার্কেও এদের অবাধ বিচরণ রয়েছে। এরা দালালদের সহায়তায় নানা অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সিনেমা হল ও বিনোদনস্পটগুলোকে তারা বেছে নেয় খদ্দের সংগ্রহ করার স্থান হিসেবে। খদ্দেরের সঙ্গে রফা হওয়ার পর সুবিধাজনক স্থান বেছে নেয়। রাজধানীজুড়ে দিন দিন এই ধরনের যৌনকর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এই শ্রেণির যৌনকর্মীরা ভাসমান, তারা এক সময় একটি এলাকা বেছে নিয়ে কাজ করে। কাজের সন্ধানে রাস্তায় নামার পর তারা বোরকা পরে থাকে, দালালদের মাধ্যমেই তারা সবকিছু ম্যানেজ করে। যারা নিয়মিত গ্রাহক তারা খুব সহজেই ‘ভাড়াটে বান্ধবী’দের অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারেন। রাতভর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কৌশল বদলে অনেকেই এই নতুন পথ ধরছে। রাজধানীজুড়ে এমন ‘ভাড়াটে বান্ধবী’র সংখ্যা প্রায় ৫ শতাধিক। সঙ্গে রয়েছে আরও প্রায় শতাধিক দালাল চক্র। এই ধরনের যৌনকর্মীদের চাহিদা স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে বেশি।
পথে পথেই জীবন
রাত সাড়ে ১১টা। স্থান বিজয়নগর। রাস্তার ওপর যানবাহনের সংখ্যা কম, কারণ পরদিনই বিরোধীদলের হরতাল। শহর জুড়ে নিরাপত্তা ছিল চোখে পড়ার মতো। ফুটপাতের ওপর কারও উপস্থিতি তেমন নেই। কিছুক্ষণ পানির ট্যাঙ্কের সামনে অপেক্ষা, কথা হয় এক নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে। বলছিলেন, ‘এদিকে রাত ১২ টার আগে কারও দেখা পাওয়া যায় না। রাত গভীর হলে দুই-একজন এদিকে আসে।’ কথা বলতেই বলতেই দূরে কারও আনাগোনা চোখে পড়ে।
একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা হয় সীমা নামের প্রায় পঁচিশ বয়সী সেই যৌনকর্মীর সঙ্গে। শুরুতে আপত্তি করলেও পরে সহজভাবে কথা বলেন। তিনি জানালেন, ‘আইজক্যা তিন বছর ধরে এই কাম করি। প্রত্যেকটি কামের জন্য ৫০ টাকা পাই, কেউ খুশি হলে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি দেয়। রাইতে ১১ টায় আসি, ভোরের আগেই চলে যাই। পরতেক দিন (দৈনিক) সাড়ে ৭শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকাও পাই। যাওয়া-আসা খরচ আর খাওয়া বাদ দিলে ৫শ’ টাকার বেশি থাকে না। মাঝে মইধ্যে শরীর খারাপ হলে কামে আইতে পারি না।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে সীমা আরও জানায়, ‘রাস্তায় অনেক ঝামেলা। এলাকার মাস্তান আছে, তারা কাম করলে টাকা দেয় না। টাকা না দিলে এলাকা থেকে মাইরা বের কইরা দেয়। পুলিশ সবসময় ধরে না, ধরলে দুই-একদিন থাকা লাগে। গতর-খাটার ট্যাকা পুলিশরে না দিয়া দুইদিন জেলখানায় থাকা ভাল’।
শুধু পল্টন-বিজয়নগর নয়, রাজধানীজুড়েই রয়েছে ‘সীমা’দের আনাগোনা। রাতভর এই রাজধানীতে ‘সম্ভ্রম’ হাতের মুঠোয় নিয়ে ‘পরপুরুষ’-এর অপেক্ষায় থাকে প্রায় দেড় হাজার যৌনকর্মী, জীবিকার প্রয়োজনে। নগরীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা, বাস-ট্রাক স্ট্যাণ্ড, নৌ ঘাট, রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় রাতভর তাদের দেখা মেলে। সন্ধ্যার আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাতভর যে যার মত করে ‘খদ্দের’ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অর্থ উপাজর্নের জন্য। দিনের আলোয় ব্যস্ততম যেখানে পা রাখার জায়গা থাকে না, অন্ধকারে সেখানে ভীড় জমায় যৌনকর্মীরা। আবাসিক এলাকার গলি থেকে ব্যস্ততম সড়ক-দ্বীপ সবখানেই তাদের দেখা মেলে। সরকারি-বেসরকারি একাধিক সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্রের তথ্যানুযায়ী, নগরীজুড়ে ভাসমান প্রায় ৫ হাজার যৌনকর্মী রয়েছে। কারও কারও মতে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
অনুসন্ধানে মিলেছে, ভাসমান যৌনকর্মীরা গড়ে ৫ দিন পথে দাঁড়ায়। বাকি দুইদিন অসুস্থতায় কিংবা পরিবারের সঙ্গে কাটে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দৈনিক প্রায় ৩ হাজার ভাসমান যৌনকর্মী পথে নামে জীবিকার জন্য। একজন যৌনকর্মী একবার মিলিত হওয়ার জন্য ৫০ টাকা থেকে সর্Ÿোচ্চ ৮০ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকে। দৈনিক গড়ে ১০ থেকে ১২ জনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর রাত শেষে আয় দাঁড়ায় এক হাজার টাকা পর্যন্ত। সপ্তাহান্তে এক-দুইদিন রোজগার বেশি বা কম হয়। আর প্রতি ১৫ দিনে একবার পুলিশ কিংবা সন্ত্রাসীর হাতে ছোট-বড় হামলার শিকার হতে হয়। নগরীর ভাসমান যৌনকর্মীদের প্রায় অর্ধেক কোনো না কোনো মাদকে আসক্ত। যৌনরোগ তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। অন্যদিকে কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ যৌনকর্মী বিভিন্ন প্রতারণা-ধর্ষণ ও সংসার থেকে বিতাড়িত হয়ে এ পথে পা বাড়ায়। এছাড়া এই ভাসমান যৌনকর্মীদের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ‘হিজড়া’ রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্পর্শকাতর এলাকায় আড়ালে-আবডালে রুটিরুজির ধান্ধা করে অনেকেই।
রাত সোয়া একটা। হাইকোর্ট চত্ত্বরের প্রধান ফটকের সামনে। চারপাশে কয়েকটি রিকশা, আর দুই একটি খাবারের দোকান। বেশ কয়েকজন শুয়ে আছেন ফুটপাতের ওপর। খাবারের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক যৌনকর্মী, নাম পারুল। জাতীয় ঈদগাহ মাঠের সামনে গাছের নিচে ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করে প্রায় ৩০ বছর বয়সী এই নারী। সাবলীলভাবে শুরু করলেও তার কণ্ঠ থেমে আসে একসময়। ‘ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে বের আসার পর একটি এতিমখানায় আশ্রয় হয়েছিল। কিছুদিন থাকার পর সেখানকার কিছু মানুষ যৌতুকবিহীন বিয়ের কথা বলে আমাকে ৩৫ বছর বয়সী একজনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমার বয়স তখন ১২ থেকে ১৩ বছর। আমি সেখান থেকে পালিয়ে আসি।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে ঘামছিলেন শ্যামবর্ণের এই ?ময়েটি। ধাতস্থ হয়ে আবার শুরু করলেন, ‘আরও ৭-৮ বছর পর, তখন একা থাকতাম। একদিন এক সন্ত্রাসী আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে ধর্ষণ করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, রক্তাক্ত অবস্থায় একটি ক্লিনিকে সেই আমার চিকিৎসা করায়। পরে আমার সম্পর্কে বাজে কথা ছড়ায়, পরিবার থেকেও আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। কিছুদিন পর এক মাদকাসক্তের সঙ্গে বিয়ে হয়, সে ঘরে খারাপ লোকদের নিতো। আমি রাজি না হলে মারধর করতো। প্রায় ৬ মাস পর আমি প্রায় ৬ বছর আগে এই পথে নামি। গতর খাটাইয়্যা যদি খাইতে হয়, তাইলে স্বামী দিয়া কী করবো? এখন সারাদিন কাজ করি, সন্ধ্যার এইহানে আসি। রাতভর রাস্তায় থেকে ১২শ’-১৫শ’ যা পাই ভালভাবে চলতে পারি। সপ্তাহে একদিন স্বামীর কাছে যাই।’
এ প্রসঙ্গে রাত দেড়টার দিকে হাইকোর্টের সামনে দায়িত্বরত এক টহল পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলছিলেন, ‘যৌনকর্মীদের আনাগোনা থাকে। আমরা বাধ্য না হলে তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না। আবার সবসময় তাদের ছাড় দেওয়ারও সুযোগ থাকে না। কারণ এই যৌনকর্মীদের ক্লায়েন্টরা অধিকাংশই মাদকাসক্ত কিংবা ছিঁচকে অপরাধী। তাদের ধরার জন্য অনেক সময় রেইড দিলে যৌনকর্মীরা সেখানে পড়ে যায়।’
হোটেল নামের সেক্স ট্রেড সেন্টার
কারওয়ান বাজার, রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা। ব্যবসার বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র পরিচয়ের বাইরে মিডিয়াপল্লী বলেও এই এলাকার নতুন পরিচয় রয়েছে। নানা কারণে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত আবাসিক হোটেল। কারওয়ান বাজারের গলি ধরে চলাফেরার করার সময় একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে ছোট্ট আকারের ভিজিটিং কার্ডের মত কিছু। সেগুলোতে কেবল বড় অক্ষরে মোবাইল নম্বর লেখা থাকে, নামের সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের নাম লেখা থাকে কখনও কখনও। সম্প্রতি তেমনই একটি কার্ড হাতে পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করি।
জানা গেল, কিছুদিন আগে যৌন বাণিজ্যের অভিযোগে বন্ধ করে দেওয়া হয় এই এলাকার বেশকিছু আবাসিক হোটেল। মাস দুয়েক আগে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে মোটা অঙ্কের মাসোহারা ও অগ্রিম টাকা দেওয়ার পর ফের শুরু হয়েছে যৌন বাণিজ্য।
মাসের শেষ সপ্তাহ। এক সন্ধ্যায় ফোন করি ঃ৪৫৪১১৪২ নম্বরে। উদ্দেশ্য ওপার থেকে রাজু নামের কারও সঙ্গে কথা বলা। ‘আমি তোমার মনের ভিতর একবার ঘুরে আসতে চাই..’ শোনার পর জবাব আসে, হ্যালো, কে বলছেন? ‘আমি রাজু নামের একজনের সঙ্গে কথা বলতে চাই..’ জানাতেই পাল্টা কিছু প্রশ্ন। সেগুলোর জবাব দেওয়ার পর কোথায় অবস্থান করছি জানতে হাওয়া হয়। শাহবাগ বলার পর উত্তর এলো, বনানী কাকলীতে এর সামনে আসতে কতক্ষণ লাগবে? উত্তর দেওয়ার পর ঠিক হলো এক ঘন্টার মধ্যে আসছি।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। কাকলী বাসস্ট্যান্ডে এসে ফোন করি। এবার ওভারব্রিজের সামনে দিয়ে অল্প এগিয়ে মোড়ে ছোট্ট পান দোকানের কাছে দাঁড়াতে বলা হয়। সেখানোর দাঁড়ানোর পরই মাঝারী গড়নের শ্যামবর্ণের এক যুবক সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে অনুসরণ আরেকটু মহাখালীর দিকে অল্প একটু সামনে এগিয়ে ডানদিকেই গলিতে ঢুকে পড়ে ছেলেটি। সেখানে আরও কয়েকজন দাঁড়ানো ছিলো। গলির এ কোনায় কলাপসিবল গেইট লাগানো সিঁড়ি, তার বিপরীতে একটি ছোট্ট পানের দোকান। কিছু না বলেই ছেলেটিকে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে যাই। হাতের ডানপার্শ্বে সিড়ি। সিড়ির মুখেই বেশ কয়েকজন যুবক দাঁড়ানো, একটি কাঠের বেঞ্চিতে দুই-তিনজন মেয়েও বসে আছে। উৎকট মেকআপ আর গায়ে রঙ্গিণ গেঞ্জি বলে দিচ্ছে তারাও যৌনকর্মী।
সরু গলি ধরে বেশ কয়েকটি কামরা পেরিয়ে গলির প্রায় শেষ মাথা, ছেলেটি ডানপার্শ্বে একটি কাঁচে ঘেরা ঘরে ঢুকলো, সেখানে সারিবদ্ধ হয়ে বসে আছে বিভিন্ন বয়সী কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ জন। কেউ বসে আছে, কেউবা খুনসুঁটিতে ব্যস্ত সতীর্থদের সঙ্গে। ইশারায় যে কোনো একজনকে বেছে নেওয়ার ইঙ্গিত করে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করি। চারপাশের উৎকট গন্ধ নাকে লাগে। রাত তখন প্রায় ৮টা। গলির ভেতরে আরও অনেকেই চলাফেরা করছে। ছেলেটি বেরিয়ে এসে কিছু না বলে হাত ধরে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে ঢুকে বলে, ‘মামা, আপনি ভিআইপি খাবেন?’ হ্যাঁ সূচক উত্তর পেয়ে দুই-তিন সেকেণ্ড চুপ থেকে আবার বলে ওঠে, ‘এক শট এক হাজার টাকা, তার চাইতে এখানেই এক ঘন্টা একটা দিয়ে দেই। আর দুইশ টাকা দিয়েন, ৩টা করতে পারবেন, সার্ভিস ভাল হবে। ওয়েস্ট ইনের মেয়েরা ভাল, তারা খারাপ ব্যবহার করে না। আপনি বসেন, দেখি..’। ছেলেটি বের হয়ে যায়। ঘরটি খুব বড় নয়, চারপাশে নোংরা-আবর্জনা। দুই-একটি কনডমের খালি প্যাকেটও আছে। বাথরুমের দরজা নেই, সেখানে আলো জ্বলছে। বাথরুমের পাশেই জানালা, বিশেষভাবে ঢেকে রাখা। এপার থেকে ব্যস্ততম সড়কটির সবকিছু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ওপাশ থেকে দেখার উপায় নেই। ময়লা বিছানার চাদর, তখনও এলোমেলো। বিছানার ওপর একপাশে কনডমের খালি প্যাকেট, দূর্গন্ধে টেকা দায় হলে বেরিয়ে আসি। আমি বের হতেই কক্ষের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে এক যুবক, পেছনে গেঞ্জি আর জিন্স প্যান্ট পরা একটি পাতলা গড়নের মেয়ে। কিছুক্ষণ পর দরজা বন্ধ হয়, তখনও আলোা আসছিলো দরজার নিচ দিয়ে।
কিছুক্ষণ পর ছেলেটি ফিরে আসে, সঙ্গে একটি অল্পবয়সী মেয়ে। চোখে মুখে তার তৃপ্তির হাসি। কিন্তু কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসায় তারা দুইজনই বিরক্ত। মেয়েটি কিছু একটা বলে চলে গেল, ছেলেটি অপেক্ষা করতে হবে বলে একপাশে ডেকে নিয়ে বললো, ‘সব এনগেজ, একটু নিচ থেকে ঘুরে আসেন। কিছু বললে আমার কথা বলেন। আর কিছু টাকা দিয়ে যান। তিন-চারশ’ বুকিংঃ’। তার হাতে দুইশত টাকা ধরিয়ে দিলে পুতি-দূর্গন্ধময় আবাসিক হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকি, তখনও অনেকেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। নিচে নামার পর আবও একবার খেয়াল করি, এই যৌন বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম ‘ওয়েস্ট ইন’।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হোটেলটির তিনতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত এই বাণিজ্য চলে। ওপরের তলায় ‘ভিআইপি’ বলে কিছু যৌনকর্মী থাকে। সাধারণ যৌনকর্মীর বেলায় প্রত্যেকবার পাঁচশ’ টাকা থেকে সাড়ে পাঁচশ’ টাকা আর ‘ভিআইপি’ হলে এক হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এই টাকা থেকে যৌনকর্মীরা পায় ৮০ থেকে ২০০ টাকা। দালালরা পায় একশ টাকা, বাকি টাকা জমা হয় ফাণ্ডে। এই ফাণ্ড থেকেই মালিক সবকিছু ম্যানেজ করে। দৈনিক সকাল ৯ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত দুই শিফটে এখানে প্রায় ২০০ জন যৌনকর্মী আসে। আর একজন যৌনকর্মী আট ঘন্টায় কমপক্ষে ১৫ জনের সঙ্গে মিলিত হয়। সাধারণ যৌনকর্মীদের কেউ কেউ কনডম নিলেও বকশিশ দিলে ‘ভিআইপি’ যৌনকর্মীরা কনডম ছাড়াও মিলিত হয়। পুলিশ বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা রেইড দেওয়ার আগেই খবর পেয়ে পাততাড়ি গুছিয়ে নেয়। প্রায় ৩ বছরের বেশি সময় ধরে এই হোটেলে যৌন বাণিজ্য চললেও এখন পর্যন্ত এখান থেকে কোনো যৌনকর্মী-দালাল আটক করা হয়েছে- এমন তথ্য মেলেনি।
এটি বনানীর বহুল আলোচিত কথিত আবাসিক হোটেলগুলোর একটি। এরকমই আরো প্রায় অর্ধশত ‘আবাসিক হোটেল’ হোটেল নামের যৌন বাণিজ্য কেন্দ্র রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এই হোটেলগুলোতে কমপক্ষে এক হাজার যৌনকর্মীর আনাগোনা হয়। প্রত্যেকটি হোটেলে দিনভর প্রায় তিনশ’ খদ্দের আসা যাওয়া করে। ছুটির দিনগুলোতে এই সংখ্যা বাড়ে। এই যৌন বাণিজ্য থেকে প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করে পুলিশ প্রশাসন। টাকার অঙ্ক নিয়ে বনিবনা না হলে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে রেইড করে পুলিশ। একাধিক সূত্র দাবি করেছে প্রতিটি হোটেল থেকে প্রতিমাসে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা আদায় করা হয় প্রশাসনের নামে। প্রায় মাস দুয়েক আগে কমপক্ষে ৩ মাস বন্ধ করে রাখার কারণ ছিল দ্বন্দ্ব। পূর্বের তুলনায় হোটেল প্রতি প্রায় এক লাখ টাকা মাসোহারা বৃদ্ধির পরই নতুন করে চালু হয়েছে ব্যবসা। মাঝে মাঝে কৌশলগত কারণে বন্ধ রাখা হয় এটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর পল্টন, বিজয়নগর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কাকরাইল, মগবাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, গাবতলী, বনানী, বিশ্বরোডসহ প্রায় অর্ধশতাধিক স্পটে অবাসিক হোটেলের নামে যৌন বাণিজ্য চলছে। নগরীতে হোটেল ভিত্তিক যৌনকর্মীর সংখ্যা পাঁচ হাজারের কাছাকাছি, বিভিন্ন সময়ে এই সংখ্যা কমবেশি হয়। দৈনিক আবাসিক হোটেল এবং বোর্ডিং নামের যৌন বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে কাজ করে প্রায় আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার যৌনকর্মী। একজন যৌনকর্মী দৈনিক গড়ে ১৫ জনের সঙ্গে মিলিত হয়। দিনশেষে তার আয় দাঁড়ায় ১২ থেকে ১৫শ’ টাকা। অন্যদিকে এই যৌনকর্মীদের দেহ ও সম্ভ্রমকে পুঁজি করেই দৈনিক প্রায় ২০ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়, এই টাকার অর্ধেক চলে যায় প্রভাবশালী মালিকপক্ষের কাছে। আর বাকি অর্ধেক ভাগবাটোয়ারা হয় দালাল ও যৌনকর্মীর মাঝে। মালিকপক্ষ প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডারদের ম্যানেজ করে বলে তথ্য রয়েছে।
এই তথ্যের সত্যতার সন্ধানে মগবাজারের একটি হোটেলে কথা হয় সালমা নামের এক যৌনকর্মীর সঙ্গে। ছদ্মনামের প্রায় ১৯ বছর বয়সী এই মেয়েটির বাড়ি খুলনায়। সে জানায়, ‘আমগো শরীল দিয়া বাণিজ্য হয়, হেইডা থেইক্যা আমরা পাই তিনভাগের একভাগেরও কম। ধরেন আপনে ৩০০ ট্যাকা দিয়া কাম করলেন, আমারে দিলো ৮০ টাকা, আর সত্তর ট্যাকা রাখলো যেই নিয়া আইছে হেই ব্যাটা। বাকি ট্যাকা ফাণ্ডে জমা হয়। অহন তো আর ফেরার উপায় নাই, তাই সহ্য করি।’
ভাবী-আন্টিদের রঙ্গশালা!
রাজধানীর যৌনবাণিজ্যে ‘ভাবী’ বা ‘আন্টি’ বহুল ব্যবহƒত শব্দ। ভাসমান, হোটেল এর বাইরে আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাট বাসায় ‘কিছুটা উঁচু’ গোছের যৌনকর্মীরা এই ‘ভাবী’ ও ‘আন্টি’দের নিয়ন্ত্রণে। এগুলো নিয়ে আড়ালে-আবডালে কথা হলেও সবসময় এই ‘অভিজাত যৌনপল্লী’র নিয়ন্ত্রকরা থাকেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। অনুসন্ধানকালে এই যৌন বাণিজ্যের নেটওয়ার্ক খুঁজতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়েছে, পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়ও। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকায় বহুবছর ধরে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে ‘অভিজাত যৌনপল্লী’। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, বেসরকারি চাকুরে থেকে শুরু করে গৃহকর্মী নারীদের কেউ কেউ এই বাণিজ্যের পণ্য হচেছন। জীবন যাত্রার ব্যয় মেটাতে অনেকেই আবাসিক এলাকায় খুলছেন যৌন বাণিজ্য কেন্দ্র। সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী খুঁটির জোরেই এই অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে। রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রশাসনের দায়িত্বশীল কিছু ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরেই এই বাণিজ্য চলছে। মুঠোফোন আর পূর্ব পরিচয় হচেছ এই বাণিজ্যের গোপনীয়তার শর্ত। মুঠোফোনে আলাপের পর বিশ্বস্ত কারও নাম ও পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই পা বাড়ায় যৌন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতরা। অনুসন্ধানের জন্য শুরুতেই আমরা সন্ধান করি এই ধরনের বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত একাধিক ‘ভাবী’ ও আন্টি’র। বেশকিছু তথ্য উপাত্তের পর সেখান থেকে বেছে নিয়ে কৌশলের সঙ্গে পা বাড়াই।
মাসের প্রথম সপ্তাহ। আমরা ফোন করি একটি মুঠোফোনে। ওার থেকে ভরাট গলায় এক জানতে চান, ‘নম্বরটি কী আমাদের কারও কাছ থেকে পেয়েছেন?’ উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার পর ওপার থেকে বলা হয়, ‘কখন আসবেন?, রাত ৯ টার পর কাউকে অ্যালাউ করি না। আর রেট তো জানেন, দুই হাজার টাকা এক শট। আসতে চাইলে বলেন, আমি বুকিং দিয়ে রাখি’।
ঠিক হলো, আমরা সন্ধ্যায় আসছি। সঙ্গে এক বন্ধু থাকবেন। ট্যাক্সিযোগে আমাদের প্রথম গন্তব্য মিরপুর দশ নম্বর। সেখানে পৌঁছুনোর পর ফোনে জানানো হলো, ‘আসলে আমরা একটা অন্য জায়গায় আটকে গেছি, দেরি হচ্ছে। এখনেও ভাল মাল আছে। চাইলে চলে আসতে পারেন, কল্যাণপুরের আরও সামনে।’ আমরা সেই মোতবেক অনুসরণ করি। আর দুই দফায় ঠিকানা বদলানোর পর শেষ গন্তব্য লালমাটিয়ার শেষ প্রান্ত, মোহাম্মদপুরের কাছকাছি। মেইন রোডে নেমে ফোনের কথামতো অনুসরণ করতে করতে পৌঁছাই একটি গলির ভেতরে। গলির শেষ মাথায় বিলাসবহুল একটি ছয়তলা ফ্ল্যাট। মূল ফটকের আগেই নিশ্চিত করে সঙ্গে বাড়তি কেউ আছে কিনা? তারপর ‘মূল ফটক খোলা আছে, দোকান থেকে কোল্ড ড্রিংকস বা অন্য কোনো খাবার নিয়ে ভদ্র অতিথির মত ভেতরে আসেন। তিন তলার আগে ফোন দেন।’ কথামতো আর কিছু ঝক্কির পর পৌঁছাই গন্তব্য পর্যন্ত। এরপর কিছুসময় অপেক্ষা করে একটি এনজিও’র কর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বলি। কিছু প্রাথমিক তথ্য ও জানার পর ‘এক হাজার’ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসি। নিচে নেমে আসার পর দারোয়ান পরিচয়ে আরও একজন এসে বকশিশের নাম করে দুইশ টাকা চায়, তার সঙ্গেও কথা বলি।
অনুসন্ধানে মিলেছে, নগরীজুড়ে এইরকম প্রায় ১৫টি অভিজাত এলাকায় শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং বাড়াবাড়ি রকম গোপণীয়তার মধ্য দিয়ে যৌন বাণিজ্য চলছে। কমপক্ষে দেড় শতাধিক আবাসিক ফ্ল্যাটে যৌন বাণিজ্য চলে। একটি ফ্ল্যাটে দৈনিক সর্বোচ্চ ৫ জন পর্যন্ত যৌনকর্মী উপস্থিত থাকে। একবার মেলামেশার জন্য কমপক্ষে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত গুণতে হয়। আর যৌনকর্মীরা পায় প্রতিবারের জন্য পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত। ফ্ল্যাট বাসায় এলাকাভেদে ব্যয়ের অঙ্ক কমবেশি হয়। আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী পরিচয়ে যৌনকর্মীরা আসে। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক রাজধানীর থেকে নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে আসে। ফ্ল্যাটে থাকে আত্মীয় পরিচয়ে। আর যৌন বাণিজ্যের সামনে থাকা ‘ভাবী’, আন্টি’র নেপথ্যের শক্তি স্থানীয় প্রভাবশালী কোনো চক্র। ফ্ল্যাটের দারোয়ান বা সিকিউরিটি গার্ডরা মাসে উপরির বিনিময়ে প্রচ্ছন্নভাবে সাহায্য করছে। যান্ত্রিকতার কারণে ফ্ল্যাটে অতিথি বেশে কে আসছে? কে কার বাসায় যাচ্ছে? খোঁজ করার সময় কী কারও আছে?
সূত্র আরও জানায়, নগরীতে এই ধরনের যৌন বাণিজ্যে গোপণীয়তার কারণে বেসরকারি সংস্থাগুলো সবসময় সঠিক সংখ্যা বের করতে হিমশিম খায়। একাধিক সংস্থার মতে, ফ্ল্যাট বাসায় যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করা যৌনকর্মীর সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। এদর অর্ধেকেই স্বামীর অক্ষমতা বা সংসারের স্বচ্ছলতার জন্য এসব করে। যৌন তাড়না থেকে ফ্ল্যাটে আসেন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। যারা শখ ও অর্থের চাহিদা দুটোই একসঙ্গে পূরণে বিশ্বাসী। অভিজাত এলাকায় বসবাস এবং চলাফেরায় শৌখিনতার ছাপ দেখে যৌনকর্মী বা এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বলে বোঝার উপায় থাকে না।

,
Powered by Blogger.