নির্বাচন নাও হতে পারে, নজর রাখছে সেনাবাহিনী

গতকাল অনলাইন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত ‘টারময়েল ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ।
মির্জা জুলফিকুর রহমান: স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে এক মাসের বেশি সময় ধরে
 আন্দোলন চলছে। সেখানে বিপুল মানুষের সমাবেশ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার নৃশংসতার ছবি আঁকা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
সুদূর রংপুর থেকে অনেক গ্রামের মানুষ এসে এ সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। তারা টেলিভিশনে যে দৃশ্য দেখেছেন তার অংশ হতে ছুটে এসেছেন শাহবাগে। তবে ঢাকার
অন্য অংশগুলোর রাজপথ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এর এক পক্ষে রয়েছে জামায়াত-ছাত্রশিবির। অন্য পক্ষে রয়েছে পুলিশ।
জামায়াত-শিবির ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বেশ কতগুলো হরতাল ও ধর্মঘট করেছে। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা ও আওয়ামী লীগের পাল্টা পদক্ষেপ এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কলেজ ক্যাম্পাস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শহরে বসবাসকারী ও গ্রাম পর্যন্ত বাংলাদেশে ভীষণভাবে রাজনীতিকরণ হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যে অনেক রকম কথা আছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, সামপ্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নির্বাচনমুখী।
অন্যরা মনে করেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ আদালত নিরপেক্ষভাবে বিচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়গুলোর সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক থাক বা না থাক দীর্ঘদিন তা অনিষ্পন্ন অবস্থায় ছিল। তবে অন্য আরেকটি পক্ষ মনে করে, শাহবাগের আন্দোলন ও জামায়াতের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থান অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এর দায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। বাংলাদেশ এখন গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে। এ অবস্থা গণতন্ত্র ও অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। এই পক্ষ বিশ্বাস করে, পরিস্থিতির দিকে ঘনিষ্ঠ নজরদারি করছে দেশের সেনাবাহিনী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। এমনকি, তা হতে পারে ঢাকায় সামরিক হস্তক্ষেপ।
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন না-ও হতে পারে। জামায়াত-শিবির একটি চৌকস দল। গত কয়েক দশকে তারা বাংলাদেশে ভিত্তি মজবুত করেছে। তাদেরকে নিষিদ্ধ করা যাবে না। শাহবাগের আন্দোলনকারী অথবা সরকার তাদেরকে যেভাবে চিহ্নিত করতে চাইছে তা-ও তারা করতে পারবে না। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে জিদ ধরা ও পাল্টা জিদ ধরা। এতে বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমবর্ধমান হারে বিভক্ত হচ্ছে। চট্টগ্রামের দক্ষিণে কক্সবাজার হলো জামায়াত-শিবিরের শক্ত ঘাঁটি। সেখানে স্থানীয় শহীদ মিনারে শাহবাগের আন্দোলনের সমর্থনে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। হরতাল চলাকালে এ ঘটনায় পুরনো শহর এলাকায় উত্তেজনা দেখা যায়।
কক্সবাজারে বসবাসকারী বাংলাদেশী রাখাইনের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। টেকনাফের স্থল ও নদী পথে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত বাণিজ্য চালিয়ে থাকে তারা। দেশের রাজনৈতিক এই অবস্থায় উদ্বিগ্ন রাখাইন সমপ্রদায়ও। তবে তারা হুমকি অনুভব করছে না।
সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশের পক্ষে কথা বলে। তারা এই পরিবেশেই বসবাস করছে দশকের পর দশক। কক্সবাজার সীমান্তে বাণিজ্যের ধরন ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংখ্যাগুরু মুসলিম ও সংখ্যালঘু রাখাইন সমপ্রদায়ের মধ্যে নিঃসন্দেহে রয়েছে প্রচণ্ড আন্তঃনির্ভরতা। রাখাইনরা স্বীকার করেন, তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে আলাদা নন। হরতাল ও সহিংসতা অব্যাহত থাকলে তাতে তাদের ওপরও প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশী রাখাইনরা বাংলা ও রাখাইন ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। কিছু তরুণ-তরুণী বলতে পারেন হিন্দি। এই ভাষাটি তারা শিখেছেন ভারতীয় বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের শো দেখে। তাদের অনেকেই এখনও মিয়ানমার সফর করেন নি, কোন বাধা না থাকলেও। ব্যবসা ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারে যাওয়ার জন্য অস্থায়ী পাস দেয়। কিন্তু হাতেগোনা কিছু ব্যবসায়ী মিয়ানমার সফরে যান নিয়মিত ভিত্তিতে।
বাংলাদেশে যখন অনেক হিন্দু গ্রামে জামায়াত-শিবির আক্রমণ করছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে তখন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল রাখাইন বৌদ্ধরা ওই রকম কোন হুমকিতে নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতের নেতাদের বিচার হচ্ছে। এতে হিন্দুরা সাক্ষ্য দেয়ায় তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। বাংলাদেশে যে কোন বিপ্লবী পরিবর্তনের সফলতা ও তার স্থায়িত্ব নির্ভর করে কিভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায় তাতে অংশ নিচ্ছে ও জড়িত হচ্ছে তার ওপর।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিশাল অংশ হলো মিয়ানমারের শরণার্থী। তারা বৈধ ও অবৈধ অভিবাসী- এই দু’শ্রেণীতে বিভক্ত। ধারণা করা হয়, ৬০ হাজারেরও বেশি অবৈধ রোহিঙ্গা অভিবাসী কক্সবাজার ও এখানে-সেখানে নিবন্ধিত শিবিরগুলোতে বাস করছে। তাদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। গত দু’দশক ধরে এ নিয়ে বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছে। সমপ্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা হয়েছে। তাতে সীমান্ত পেরিয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশী রাখাইন জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা অভিবাসীদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখে না। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামপ্রতিক জাতিগত দাঙ্গার ঘটনায় দেখা দিয়েছে উত্তেজনা। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাই কমিশনার আহ্বান জানালেও তাতে সায় না দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
একই ধর্মের অনুসারী হওয়ায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি দৃশ্যত জামায়াতের সমর্থন আছে। এসব মানুষের বেশির ভাগই অশিক্ষিত ও জীবনযাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় জামায়াত মনে করে এদের মধ্যে তাদের আদর্শ ঢুকিয়ে দেয়া সহজ। অভিযোগ আছে, সমপ্রতি বাংলাদেশে জামায়াত-শিবির বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে হামলা ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে তাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে রোহিঙ্গা অভিবাসীদের। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য এবং মিয়ানমারে যে সংস্কার শুরু হয়েছে সেই রকম করে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের স্বার্থে ব্যাপক উন্নয়ন ও কৌশলী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে।
মির্জা জুলফিকুর রহমান গুয়াহাটির আইআইটিতে ডিপার্টমেন্ট অব হিউম্যানিটিস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ পিএইচডি থিসিস করছেন।
 source: hello-today

Powered by Blogger.