তিন বছর ধরেই শয্যাশায়ী জিয়াউল হক রতন-দুই কিলোমিটার দূরে গিয়ে পুলিশকে মেরেছেন ইট!

তিন বছর ধরেই শয্যাশায়ী জিয়াউল হক রতন। মেরুদণ্ডে অপারেশনের ধকল কাটেনি এখনও তার। ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ায় বাড়ির আশপাশে দু’বেলা হাঁটেন লাঠি ভর করে। চলাফেরায় প্রায় পঙ্গু ৬২ বছর বয়সী এ মানুষটিকেই করা হয়েছে বোমা বিস্ফোরণ আইনে দায়ের করা একটি মামলার আসামি। পুলিশ বাদী মামলাটির এজাহারে বলা হয়েছে তিনি নাকি পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল
নিক্ষেপ করেছেন। তা-ও অন্য এলাকায় গিয়ে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে লাঠি ভর করেই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। রাত কাটাতে হচ্ছে এখানে সেখানে। বলেন, ‘বাবারে গ্রেপ্তারের ভয়ে ঘুম হারাম অইয়া গেছে। আমারে আসামি করা হয়েছে এ খবর জানার পর থেকেই টেনশনে মরছি। বুধবার রাতে দু’টি ট্যাবলেট খেয়েও ঘুমাতে পারিনি।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ১৯শে মার্চ হরতালের সময় শহরের পুনিয়াউট ও শেরপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার ২২ নম্বর আসামি জিয়াউল হক রতন। মামলার এজাহারে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, শেরপুর বাসস্ট্যান্ডে রতনসহ মামলার ২১, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ নম্বর আসামি এবং অজ্ঞাতনামা অন্যান্য আসামি প্রাণে হত্যার উদ্দেশে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। সে সময় ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আসামি কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। রতন মিয়ার বিরুদ্ধে এজাহারে আনা অভিযোগের বিষয়টি বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে এলাকার মানুষের মধ্যে। রতন মিয়া শহরের পুনিয়াউটের মন্ত্রী বাড়ির বাসিন্দা। পুনিয়াউট বাসস্ট্যান্ড থেকে শেরপুরের দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। স্বাভাবিক চলাফেরায় অক্ষম এ লোক কিভাবে শেরপুর গিয়ে ইটপাটকেল ছুড়লো পুলিশকে লক্ষ্য করে- সেটাই প্রশ্ন এলাকার মানুষের। তিনি ৯নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপি’র সদস্য। রতন মিয়া বলেন, আমি এ পর্যন্ত ১০বার পদত্যাগ করেছি। কিন্তু আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয় না। আমি বলেছি নিজের জানের জপ (জবাব) দিতে পারি না, আমি আর রাজনীতি করবো না। তারপরও নেতারা জোর করে আমার নাম দিয়ে রেখেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৯ই মার্চ রতনের মেরুদণ্ডের জটিল অপারেশন হয়। ঢাকার সিটি, মেট্রোপলিটন এবং সর্বশেষ পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরলেও একটানা ৬-৭ মাস তাকে পুরাপুরি শয্যাশায়ী থাকতে হয়। তখন বিছানাতেই প্রস্রাব-পায়খানা সারতে হয়েছে। গত ৩-৪ মাস ধরে তিনি লাঠিতে ভর করে হাঁটেন। বলেন, ১৮ বছর ধরে আমি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। না হাঁটলে ডায়াবেটিস বেড়ে যাবে তাই লাঠি ভর করে বাড়ির আশপাশে সকাল-বিকাল কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করি। রতন বলেন, আল্লাহ আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এখনও চিকিৎসার ওপরই বেঁচে আছি। বাড়িতে আসার পরও যতবার ঢাকায় গিয়েছি, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নিয়ে গেছি। এ অবস্থার মধ্যে এমন মিথ্যা অভিযোগ এনে পুলিশ আমার বিরুদ্ধে মামলা করলো। আমি ওইদিন ঘটনাস্থলে ছিলামও না, কিছু জানিও না। শেরপুর এলাকায় যাওয়া এই শরীরে আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। তারওপর আমি নাকি আবার পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল মেরেছি। মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে এ খবর জানার পরই তিনি অন্যত্র তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে রাত কাটান। তিনি বলেন, আমাকে হাইকমোড ব্যবহার করতে হয়। ডায়াবেটিস থাকায় বারবার টয়লেটে যেতে হয়। শারীরিক এ অবস্থার মধ্যেও আমাকে পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে এখানে-সেখানে রাত কাটাতে হচ্ছে। অনেক কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। মামলাটির বাদী হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর এ কে এম মাহবুবুল আলম। এ মামলায় রতন ছাড়া আসামি করা হয়েছে আরও ৩৪ জনকে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ২৫-৩০ জনকে। এই মামলার ২৬ ও ২৭ নম্বর আসামি পুনিয়াউটের দুই সহোদর মিজান ও জালাল মিয়া। জালাল জানান, তার ছোট ভাই মিজান গত ৩-৪ মাস ধরে ঢাকায়। আর তিনি ছিলেন ওই সময় তার পোল্ট্রি ফার্মে। কখন কি হয়েছে সেটাই জানেন না। বলেন, ভাই এমন নোংরা রাজনীতি কখনও দেখিনি। এলাকার সবাই জানে আমার ভাই গত কয়েক মাস ধরে ঢাকায় আছেন। কিন্তু তাকে আসামি করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, তাদের দু-ভাইকে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই মামলায় জড়ানো হয়েছে। বাড়ির একটি জায়গা নিয়ে বিরোধের জেরেই এ কাজটি করা হয়েছে। পুনিয়াউটের খোকন মিয়ার ছেলে শিক্ষানবিশ আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন ছিলেন ঘটনার সময় কোর্টে। তাকে করা হয়েছে এ মামলার ২৮ নম্বর আসামি। এলাকার লোকজন অভিযোগ করেন, পুনিয়াউটের যে ক’জনকে আসামি করা হয়েছে তাদের কেউই ঘটনাস্থলে ছিলেন না। এব্যাপারে সাব-ইন্সপেক্টর এ কে এম মাহবুবুল আলম বলেন ওইরকম কাউকে আসামি করা হয়নি। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরই আসামি করা হয়েছে। ওই তারিখে হরতাল চলাকালে শহরের টিএ রোডে বিক্ষোভ, যানবাহন ভাঙচুর, পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং ককটেল বিস্ফোরণ করার ঘটনায় ৬২ জনের নাম উল্লেখ করে বিস্ফোরক আইনে আরেকটি মামলা দেয়া হয়। জেলা বিএনপিরসহ সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামলকে প্রধান আসামি করা হয়েছে তাতে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ৫০-৬০ জনকে। এ মামলায়ও এলাকায় নেই এমন লোকজনকে আসামি করা হয়েছে বলে দলের নেতাদের অভিযোগ। মামলার ২০ নম্বর আসামি মফিজুল ইসলাম মোহন ঢাকায় চাকরি করেন। গত ক’মাসে তাকে শহরে দেখা যায়নি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অন্যান্য আসামির সঙ্গে মিলিত হয়ে হত্যার উদ্দেশ্য পুলিশকে লক্ষ্য করে প্রচণ্ড ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার অভিযোগ আনা হয়েছে এজাহারে। এ মামলাটির বাদী হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল থানার ১নং পুলিশ ফাঁড়ির সাব-ইন্সপেক্টর বেলাল হোসেন। মামলা দু’টি দায়ের করা হয় ২০শে মার্চ।source:mzamin

Powered by Blogger.